ছেলেবেলা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBPE) অনুমোদিত পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “পাতাবাহার” । এখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেবেলা’ গল্পটি দেওয়া হল ।

ছেলেবেলা – গল্প

আমার জীবনে বাইরের খোলা ছাদ ছিল প্রধান ছুটির দেশ । ছোটো থেকে বড়ো বয়স পর্যন্ত আমার নানা রকমের দিন ওই ছাদে নানাভাবে বয়ে চলেছে । আমার পিতা যখন বাড়ি থাকতেন তাঁর জায়গা ছিল তেতালার ঘরে । চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূর থেকে কত দিন দেখেছি, তখনও সূর্য ওঠেনি, তিনি সাদা পাথরের মূর্তির মতো ছাদে চুপ করে বসে আছেন, কোলে দুটি হাত জোড়-করা । মাঝে মাঝে তিনি অনেকদিনের জন্য চলে যেতেন পাহাড়ে পর্বতে, তখন ওই ছাদে যাওয়া ছিল আমার সাত সমুদ্দুর-পারে যাওয়ার আনন্দ । চিরদিনের নীচে তলায় বারান্দায় বসে বসে রেলিঙের ফাঁক দিয়ে দেখে এসেছি রাস্তার লোক-চলাচল; কিন্তু ওই ছাদের উপর যাওয়া লোকবসতির পিলপে্গাড়ি পেরিয়ে যাওয়া । ওখানে গেলে কলকাতার মাথার উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে মন চলে যায় – যেখানে আকাশের শেষ নীল মিশে গেছে পৃথিবীর শেষ সবুজে । নানা বাড়ির নানা গড়নের উঁচুনিচু ছাদ চোখে ঠেকে, মধ্যে মধ্যে দেখা যায় গাছের ঝাঁকড়া মাথা । আমি লুকিয়ে ছাদে উঠতুম প্রায়ই দুপুর বেলায় । বরাবর এই দুপুর বেলাটা নিয়েছে আমার মন ভুলিয়ে । ও যেন দিনের বেলাকার রাত্তির, বালক সন্ন্যাসীর বিবাগি হয়ে যাবার সময় । খড়খড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে ঘরের ছিটকিনি দিতুম খুলে । দরজার ঠিক সামনেই ছিল একটা সোফা; সেইখানে অত্যন্ত একলা হয়ে বসতুম । আমাকে পাকড়া করবার চৌকিদার যারা, পেট ভ’রে খেয়ে তাদের ঝিমুনি এসেছে; গা মোড়া দিতে দিতে শুয়ে পড়েছে মাদুর জুড়ে ।

Read Also:

ছেলেবেলা – প্রশ্ন ও উত্তর | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

রাঙা হয়ে আসত রোদ্দুর, চিল ডেকে যেত আকাশে । সামনের গলি দিয়ে হেঁকে যেত চুড়িওয়ালা । -সেদিনকার দুপুর বেলাকার সেই চুপচাপ বেলা আজ আর নেই, আর নেই সেই চুপচাপ বেলার ফেরিওয়ালা ।-

হঠাৎ তাদের হাঁক পৌঁছত, যেখানে বালিশের উপর খোলা চুল এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকত বাড়ির বউ । দাসী ডেকে নিয়ে আসত ভিতরে, বুড়ো চুড়িওয়ালা কচি হাত টিপে টিপে পরিয়ে দিত পছন্দমতো বেলোয়ারি চুড়ি । সেদিনকার সেই বউ আজকের দিনে এখনও বউয়ের পদ পায়নি ! সেকেন্ড ক্লাসে সে পড়া মুখস্থ করছে । আর সেই চুড়িওয়ালা হয়তো আজ সেই গলিতেই বেড়াচ্ছে রিক্শ ঠেলে । ছাদটা ছিল আমার কেতাবে-পড়া মরুভূমি, ধূ ধূ করছে চারদিক । গরম বাতাস হু হু করে ছুটে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে, আকাশের নীল রঙ এসেছে ফিকে হয়ে ।

Read Also:

গল্পবুড়ো – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বুনো হাঁস – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

দারোগাবাবু এবং হাবু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

এতোয়া মুণ্ডার কাহিনি – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাখির কাছে ফুলের কাছে – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বিমলার অভিমান – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মাঠ মানে ছুট – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাহাড়িয়া বর্ষার সুরে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ঝড় – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

এই ছাদের মরুভূমিতে তখন একটা ওয়েসিস দেখা দিয়েছিল । আজকাল উপরের তলায় কলের জলের নাগাল নেই । তখন তেতালার ঘরেও তার দৌড় ছিল । লুকিয়ে-ঢােকা নাবার ঘর, তাকে যেন বাংলাদেশের শিশু লিভিংস্টন এইমাত্র খুঁজে বের করলে । কল দিতুম খুলে, ধারাজল পড়ত সকল গায়ে । বিছানার একখানা চাদর নিয়ে গা মুছে সহজ মানুষ হয়ে বসতুম ।

ছুটির দিনটা দেখতে দেখতে শেষের দিকে এসে পৌঁছল । নীচের দেউড়ির ঘন্টায় বাজল চারটে । রবিবারের বিকেল বেলায় আকাশটা বিশ্রী রকমের মুখ বিগড়ে আছে । আসছে-সোমবারের হাঁ-করা মুখের গ্রহণ-লাগানো ছায়া তাকে গিলতে শুরু করেছে । নীচে এতক্ষণে পাহারা-এড়ানো ছেলের খোঁজ পড়ে গেছে ।…

…দিনের আলো আসছে ঘোলা হয়ে । মন-খারাপ নিয়ে একবার ছাদটা ঘুরে আসা গেল, নীচের দিকে দেখলুম তাকিয়ে – পুকুর থেকে পাতিহাঁসগুলো উঠে গিয়েছে । লোকজনের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে ঘাটে, বট গাছের ছায়া পড়েছে অর্ধেক পুকুর জুড়ে, রাস্তা থেকে জুড়িগাড়ির সইসের হাঁক শোনা যাচ্ছে ।

Read Also:

মধু আনতে বাঘের মুখে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মায়াতরু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ফণীমনসা ও বনের পরি – নাটক | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বোকা কুমিরের কথা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মাস্টারদা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মিষ্টি – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

তালনবমী – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

একলা – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

আকাশের দুই বন্ধু – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ছেলেবেলা গল্পের লেখক পরিচিতি:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১): জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে । অল্পবয়স থেকেই ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন । ‘কথা ও কাহিনী’, ‘সহজপাঠ’, ‘রাজর্ষি’, ‘ছেলেবেলা’, ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘হাস্যকৌতুক’, ‘ডাকঘর’, ‘গল্পগুচ্ছ’-সহ তাঁর বহু রচনাই শিশু-কিশোরদের আকৃষ্ট করে । দীর্ঘ জীবনে অজস্র কবিতা, গান, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন । এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে ‘Song Offerings’-এর জন্যে । দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত আর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তাঁর রচনা । পাঠ্যাংশটি তাঁর ‘ছেলেবেলা’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে ।

Follow us:

If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.

Leave a Reply