ফণীমনসা ও বনের পরি – নাটক | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBPE) অনুমোদিত পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “পাতাবাহার” । এখানে লেখক বীরু চট্টোপাধ্যায়ের ‘ফণীমনসা ও বনের পরি’ নাটকটি দেওয়া হল ।

ফণীমনসা ও বনের পরি – নাটক

চরিত্রলিপিঃ সূত্রধার, ফণীমনসা, বনের পরি, ডাকাতদল, ঝড়, ছাগল

সূত্রধারঃ গভীর বন । তার ভেতরে ছোট্ট একটি ফণীমনসা গাছ । গাছটির মনে কিন্তু এক ফোঁটাও শান্তি নেই । আশেপাশে গাছেদের সুন্দর সুন্দর পাতা যতই সে দ্যাখে, রাগে দুঃখে মন তার রি-রি করে ওঠে । কী বিচ্ছিরি আর ছুঁচোলো পাতা তার-ভাবে সে । সবসময়েই কেঁদে কেঁদে আপশোশ করে-

ফণীমনসাঃ (সুরে)

ছি ছি ছি এমন বরাত পাতা সব যেন রে করাত,
সরাৎ সরাৎ শব্দেতে জ্বালা ধরে ।
উঁহুহু বশা-ফলক খোঁচা দেয়, রক্ত ঝলক
পলক পলক মনটা কেমন করে ।।
হায় গো বনের পরি নিয়ত তোমায় স্মরি
করুণা করো বাচ্চা গাছের ’পরে ।।

সূত্রধারঃ এমন সময় সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল বনের পরি । ওর কান্না শুনে থমকে দাঁড়াল সে । জিগ্যেস করল-

বনের পরিঃ কী হয়েছে গো আমার ছোট্ট ফণীমনসা গাছ ? কাঁদছ কেন ?

ফণীমনসাঃ তুমি এসেছ বনের পরি ? তোমার পায়ে পড়ি আমার এই বিতিকিচ্ছিরি পাতাগুলি তুমি পালটে দাও ।

বনের পরিঃ পাতা পালটাতে চাও ? বেশ । কীরকম পাতা চাও তুমি বলো !

ফণীমনসাঃ আমায় তুমি খু-ব সুন্দর সোনার পাতা করে দাও ।

বনের পরিঃ সোনার পাতা ! বেশ ! তথাস্তু !

Read Also:

ফণীমনসা ও বনের পরি – প্রশ্ন ও উত্তর | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

সূত্রধারঃ বনের পরি এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল । আর কী আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে বাচ্চা ফণীমনসা গাছের কাঁটাভরা পাতা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে গজিয়ে উঠল অজস্র ঝলমলে সোনার পাতা । বাচ্চা গাছটি তো মহা খুশি । আনন্দে ডগমগ । এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো কানে জবাফুল গোঁজা বাবরিওয়ালা একদল ডাকাত ।

ডাকাতদলঃ (সুরে)

হারে-রে হারে-রে হারে-রে হারে-রে
লুটেপুটে খাই বারেক ধরিব যারে-রে ।
মোদের সঙ্গে শক্তিতে কে বা পারে-রে !

সূত্রধারঃ সহসা সেই জোয়ান ডাকাতদলের নজর পড়ল সোনার পাতা ভরা ছোট্ট ফণীমনসা গাছটির দিকে।

ডাকাতদলঃ (সুরে)

আরে-রে আরে-রে, আরে-রে আরে-রে
গাছটা নুয়েছে সোনার পাতার ভারে-রে ।
ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বড়োলোক হয়ে যারে-রে
হারে-রে হারে-রে, হারে-রে হারে-রে ।

সূত্রধারঃ বলতে দেরি আছে কিন্তু নিতে দেরি নেই । নিমেষ মধ্যে ডাকাতেরা সব সোনার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে পোঁটলা বেঁধে ওকে একেবারে ন্যাড়া করে রেখে গেল । আর তক্ষুনি কান্নায় ভেঙে পড়ল ছোট্ট ফণীমনসা গাছ ।

ফণীমনসাঃ (সুরে)

আহা-হা উঁহু-হু ওহো-হো
আহা-হা ব্যথায় মরি হায় গো বনের পরি
আবারও তোমায় স্মরি,
করুণা করি বাঁচাও এসে মোরে ।

Read Also:

গল্পবুড়ো – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বুনো হাঁস – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

দারোগাবাবু এবং হাবু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

এতোয়া মুণ্ডার কাহিনি – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাখির কাছে ফুলের কাছে – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বনের পরিঃ আবার কী হল গো তোমার ছোট্ট মেয়ে ?

ফণীমনসাঃ (কান্নাভরা কন্ঠে) দ্যাখো দ্যাখো বনের পরি, চেয়ে দ্যাখো, ডাকাতেরা আমার কী হাল করে রেখে গেছে । সোনার পাতা আর চাই না ।

বনের পরিঃ তা হলে তুমি কী চাও ?

ফণীমনসাঃ এবার তুমি আমায় কাচের পাতা দাও ।

বনের পরিঃ কাচের পাতা ! বেশ ! তথাস্তু !

সূত্রধারঃ বনপরি অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে ছোটো ছোটো কাচের পাতায় ঝলমলিয়ে উঠল ফণীমনসা গাছের সারা অঙ্গ । সেই কাচের পাতার ওপর সূর্যের কিরণ পড়ে রামধনু রং ঝিকিমিকি খেতে লাগল । মৃদুমন্দ বাতাসের দোলা লেগে সুমধুর টুং টাং শব্দ হতে লাগল । কিন্তু এমন সময় আকাশ দিয়ে ধেয়ে এল দুর্দান্ত ঝড় ।

(ঝড়ের শোঁ-শোঁ শব্দ)

ঝড়ঃ (সুরে)

হু-হু-হু শোঁ-শোঁ-শোঁ করে
চলি মোরা দর্প-ভরে,
পবনের দুষ্টু ছেলে মোরা গো-
পত পত পত ওড়াই পাতা,
মট মট মট ভাঙি মাথা,
ছোটো বড়ো গাছের আগাগোড়া গো !
শোঁ-শোঁ-হু-হু-মট-মট-ঝন-ঝন
ওলটপালট করি যে মোরা এই তো মোদের পণ-
ঝন ঝন-ঝন ঝন-ঝন ঝন-ঝন-ঝন ।

Read Also:

বিমলার অভিমান – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ছেলেবেলা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মাঠ মানে ছুট – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাহাড়িয়া বর্ষার সুরে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ঝড় – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

সূত্রধারঃ ভয়ানক ঝড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফণীমনসা গাছের কাচের সমস্ত পাতা ধাক্কা খেয়ে খেয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গেল । এক সময় ঝড় থামল আর শুরু হলো বাচ্চা গাছের অঝোরে কান্না ।

ফণীমনসাঃ (সুরে)

হায় হায় বনের পরি, তোমার আবার স্মরি
এসো গো ত্বরা করি,
করুণা করি বাঁচাও এসে মোরে ।

বনের পরিঃ আবার কাঁদছো কেন গো আমার ছোট্ট মেয়ে ?

ফণীমনসাঃ চেয়ে দ্যাখো কী সর্বনাশ হয়েছে আমার । কাচ-ফাচ আর চাই না । তুমি আমায় এবার পালং শাকের মতো সুন্দর সবুজ কচি পাতা দাও ।

সূত্রধারঃ পরি অদৃশ্য হতেই ছোট্ট ফণীমনসার গা ভরে দেখা দিল পালং-এর মতো কচি নরম সবুজ পাতা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় । আঃ কী শান্তি ! ছোট্ট গাছটির এবার দেমাকে যেন মাটিতে পা পড়ে না । মৃদুমন্দ বাতাসে হেলতে দুলতে লাগল সে মজা করে । কিন্তু কী সর্বনাশ ! একটা ছাগল এদিকে আসছে যে-

ছাগলঃ (সুরে)

ব্যা-ব্যা-ব্যা-
যা কিছু পাই চিবিয়ে যে খাই,
ঘুরে বেড়াই ব্যা-ব্যা গান গেয়ে গো ।
মোর কাছে সব লাগে মিষ্টি
ভগবানের বেবাক সৃষ্টি;
যা কাছে পাই চিবিয়ে গিলি-
জুতো থেকে পানের খিলি !
পেটখানারে চাক করি সব খেয়ে গো-

ফণীমনসাঃ ওমা কী ভয়ানক ! দয়া করো- বাঁচাও আমায় ।

Read Also:

মধু আনতে বাঘের মুখে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মায়াতরু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বোকা কুমিরের কথা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মাস্টারদা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ছাগলঃ

ব্যা ব্যা ব্যা
ব্যা ব্যা ব্যা পালংপাতা,
আগে তোর মুড়াই মাথা;
জিবে জল ঝরছে তোরে পেয়ে গো-

সূত্রধারঃ তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ছাগলটা কচি কচি পালং পাতাগুলিকে কচকচ করে খেয়ে ফেলল । অবশেষে ছাগল চলে গেল ।

ফণীমনসাঃ (কান্নায় ভেঙে পড়ে সুরে-)

কোথা গো বনের পরি
তোমারে আবার স্মরি,
ঘাট হয়েছে কানে ধরি,
করুণা করি বাঁচাও এসে মোরে ।

বনের পরিঃ শোন গো আমার ছোট্ট মেয়ে ! আমি কাছে থেকে সব স্বচক্ষে দেখেছি । নিজের অবস্থায় আর নিজের চেহারা নিয়ে যে সন্তুষ্ট না থাকে, তার তোমার মতোই দুর্দশা হয়, বুঝলে ! শিক্ষা কিছু হয়েছে কি ? এবার বলো কী চাও !

ফণীমনসাঃ (কান্নাভরা সুরে)
আর কিছুই চাই না বনপরি ! খুব শিক্ষা হয়েছে আমার । আমায় আমার ওই কাঁটাভরা ছুঁচোলো পাতাই ফিরিয়ে দাও দয়া করে । সেই আমার শতগুণে ভালো । এই ন্যাড়া হাড়-জিরজিরে চেহারা আমি আর সইতে পারছি না ।

বনের পরিঃ এই তো সুবুদ্ধি হয়েছে তোমার । বেশ তাই হোক । তথাস্তু !

সূত্রধারঃ দেখতে দেখতে ফণীমনসার গায়ে তার নিজের রসভরা মোটা পাতা হয়ে গেল । আর কখনো সে মিছে বায়নাক্কা করেনি ।

Read Also:

মিষ্টি – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

তালনবমী – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

একলা – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

আকাশের দুই বন্ধু – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ফণীমনসা ও বনের পরি নাটকের লেখক পরিচিতি:

বীরু চট্টোপাধ্যায় (১৯১৭-১৯৮৪): শিশু ও কিশোর পাঠকদের উপযোগী রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখেছেন । তোমাদের পাঠ্য ‘ফণীমনসা ও বনের পরি’ নাটকটি ‘শিশুসাথী’ পত্রিকা (সংখ্যা ৪৩, বৈশাখ ১৩৭১) থেকে নেওয়া হয়েছে ।

Follow us:

If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.

Leave a Reply