আকাশের দুই বন্ধু – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBPE) অনুমোদিত পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “পাতাবাহার” । এখানে লেখক শৈলেন ঘোষের ‘আকাশের দুই বন্ধু’ গল্পটি দেওয়া হল ।

আকাশের দুই বন্ধু – গল্প

কে জানত, একদিন হঠাৎ ওদের দেখা হবে । ওদের বন্ধুত্ব হবে । ওদের আকাশে উড়িয়ে যুদ্ধ হবে প্যাঁচখেলার । একটা আর-একটার ঘাড়ে গােত মেরে যখন সুতােয় জড়িয়ে লাট খাবে, তখন চিৎকার করবে মানুষ আনন্দে ! হ্যাঁ, ওরা দুটি ঘুড়ি । একটার নাম চাঁদিয়াল । আর-একটা পেটকাটা ।

কে না দেখেছে, একটি বীজ মাটিতে পুঁতলে, তার থেকে কেমন করে গাছ জন্ম নেয় । গাছটি ধীরে ধীরে সবুজ পাতা ছড়িয়ে হাওয়ায় দোলে । ফুলের কুঁড়ি উঁকি মারে । ফুল ফোটে ।

আবার দ্যাখাে, ওই যে গাছে পাখির বাসা, মা-পাখি বাসায় বসে তার ডিমে কেমন তা দিচ্ছে ! দিতে দিতে ফুট করে যেই ডিম ফুটছে, ছানাপােনা কিচিরমিচির ডাক দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে । বেরিয়েই হাঁ করে মুখ তুলছে আকাশে । খাবার চাইছে মায়ের কাছে । তারা বড়াে হবে । একদিন আকাশে ডানা মেলে তারা উড়বে । কী সুন্দর দেখতে সেই পাখি ! বাহার-ছড়ানাে কী তাদের গায়ের রং । আমরা চোখ মেলে দেখব, আর মনে মনে বলব, বাঃ !

এমনি করে রােজ পৃথিবী নতুন হচ্ছে । জন্ম নিচ্ছে রােজ অসংখ্য প্রাণ । গড়ে উঠছে ভালােবাসা । আর বন্ধুত্ব । নতুন ! নতুন !

কিন্তু ওই দুটো ঘুড়ি ? ওরা তাে আর গাছও নয়, পাখিও নয় । ওদের প্রাণও নেই, ভালােবাসাও নেই । হাতে গড়া দুটো খেলনা । কাগজের । কে তাদের বানিয়েছে, সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না ! কে ছিল কোথায় তার কে হিসেব রাখে ! ওদের কিনে আনা হয়েছে দোকান থেকে । উৎসবের দিনে উড়বে ওই দুটো ঘুড়ি । তারপরে লাট খেতে খেতে ওরা লড়াই করবে আকাশে । কে যে ভোঁকাট্টা হয়ে কোথায় পড়বে, কেউ জানে না । কেউ গড়িয়ে পড়তে পারে গাছে, কিংবা ইলেকট্রিক তারে । লুটিয়ে পড়তে পারে কারও ছাদে, নয়তাে নদীর জলে । নদীর জলে নাকানিচোবানি খেয়ে তার বুকের কাঁপকাঠি ছিটকে গেলে, সে তখন কেবলই একটা ফাটা কাগজের টুকরাে । তখন কেউ চোখ ফিরিয়ে দেখবে না তাকে । আহাও করবে না, উহুও করবে না । সে তখন একটা আবর্জনা । আবর্জনা নিয়ে কে আর দয়া দেখায় !

কিন্তু একদিন উৎসব আসেই । বাজনা বাজে । মাঠে, ছাদে, পথে-প্রান্তরে ঘুড়ির উৎসবে আকাশ উপচে পড়ে । উল্লাসে ভরে যায় চারদিক । আর সেই উৎসবে ওই দুটো ঘুড়ি পাক খায় আকাশে । একটা চাঁদিয়াল, অন্যটা পেটকাটা । এ-বাড়ির ছাদ, ও-বাড়ির একফালি ফাঁকা জমি থেকে ওদের ওড়ানাে হচ্ছে । ওদের বুক ফুটো করে সুতাে বাঁধা হয়েছে । সেই বাঁধা সুতাে লাটাই ঘুরে খুলছে, ওদের হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে । ভাসতে ভাসতে উড়ে যায় । উড়তে উড়তে চাঁদিয়াল যেন আড়চোখে তাকিয়ে দ্যাখে পেটকাটাকে । পেটকাটাও দ্যাখে যেন পিটপিটিয়ে চাঁদিয়ালকে । এবার বােধহয় প্যাঁচের খেলা শুরু হবে ।

Read Also:

গল্পবুড়ো – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বুনো হাঁস – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

দারোগাবাবু এবং হাবু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

এতোয়া মুণ্ডার কাহিনি – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাখির কাছে ফুলের কাছে – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

না তাে ! এখনও তাে দুই ঘুড়ির দুই মালিকের সুতাে ছাড়ার খেলা চলছে । আরও ওপরে উঠছে ওরা । উঠতে উঠতে দুই ঘুড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে একে ওকে । দেখতে দেখতে দুলছে আর ভাবছে, তারা যেন কতদিনের বন্ধু । দুলতে দুলতে হঠাৎ যেন চাঁদিয়াল কথা বলল, এই আকাশ থেকে ওই নীচের নদীটা কী-সুন্দর দেখতে লাগছে ! কেমন এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে !

পেটকাটা যেন তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, আমাদের এক-একজন বন্ধু-ঘুড়ির ল্যাজও এমনি করে হাওয়ায় ভাসে এঁকেবেঁকে ।

চাঁদিয়ালটা বােধহয় একটু মুচকি হাসল । হাসতে হাসতে বলল, ঘুড়ির ল্যাজের সঙ্গে তুলনা করছিস নদীর ? ঘুড়ির ল্যাজ তাে এইটুকুস । আর নদী দ্যাখ কত বড়াে ! জানিস নদীর চেয়েও বড়াে সাগর !

তুই কেমন করে জানলি ? জিজ্ঞেস করল পেটকাটা ।

চাঁদিয়াল উত্তর দিল, ওই যে দেখছিস ছেলেটি আমায় ওড়াচ্ছে, ও কাল আমায় কিনে আনে । ওর পাশে ওই যে দেখছিস আর-একটি ছােট্ট ছেলে লাটাই ধরে ওকে সাহায্য করছে, ওই ছেলেটি ওর ভাই । কাল সন্ধেবেলা ভাই যখন মাস্টারমশায়ের কাছে পড়ছিল, তখন এইসব কথা শুনেছি । ওরা বলাবলি করছিল, পৃথিবীটা নাকি খুব সুন্দর । নাকি অনেক পাহাড় আছে, ঝরনা আছে । গাছ আছে, ফুল আছে । আবার কোথাও নাকি বরফ আছে, শুধুই বরফ। বরফ নাকি খুব ঠান্ডা !

Read Also:

বিমলার অভিমান – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ছেলেবেলা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মাঠ মানে ছুট – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পাহাড়িয়া বর্ষার সুরে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ঝড় – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পেটকাটা চাঁদিয়ালের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । বলল, তাের শােনাই সার, দেখা তাে আর হচ্ছে না ।

চাঁদিয়াল উত্তর দিল, ঠিক বলেছিস । একটু পরেই তাের সঙ্গে আমার প্যাঁচের লড়াই হবে । কেউ তাে একজন ভোঁকাট্টা হয়ে হারিয়ে যাব । তখন কে যে কোথায় কোন বিপদে পড়ব কে জানে । আকাশটা যদি আমাদের ঘর-বাড়ি হত ! আমরা যদি শুধুই আকাশে উড়তে পারতুম !

পেটকাটা বলল, আমরা বড়াে অসহায় না রে ? মানুষের হাতের ওই সুতাে যেমন করে আমাদের চালায়, আমরা তেমন করে চলি । আমরা তাে ওদের হাতের গােলাম ।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, জবাব দিল চাঁদিয়াল, ওদের হাতের ওই সুতাে আমাদের ভাগ্য । ওই সুতাে যদি প্যাঁচের সময় আমরা দুজনেই ছিঁড়ে ফেলতে পারি জট পাকিয়ে, তবে হয়তাে রক্ষা পেতে পারি আমরা । উপড়ে যেতে পারি একসঙ্গে আকাশে । তখন আর আমাদের ধরার সাধ্য থাকবে না কারও । আমরা তখন আর অসহায় থাকব না । আমরা তখন দুই বন্ধু মুক্ত । আকাশ আমাদের সহায় । বলতে না-বলতেই হল্লা উঠল মানুষের গলায় । দুই ঘুড়ির প্যাঁচের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল । বলতে-না-বলতেই আচমকা পেটকাটার সুতােয় টান পড়ল । তিরবেগে সে ধেয়ে এল চাঁদিয়ালের দিকে । চাঁদিয়ালও ঝাঁপিয়ে পড়ল পেটকাটার সুতাে জড়িয়ে । চেঁচিয়ে উঠল, ভয় পাস না পেটকাটা, আমি তাের সুতােয় আমার সুতাে জড়িয়ে দিচ্ছি । আমাদের প্যাঁচে ফেলেছে ওরা । আয়, আমরা প্রাণপণে টান মারি দুজনে । হয় মরব । না হয় জিতব ।

Read Also:

মধু আনতে বাঘের মুখে – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মায়াতরু – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

ফণীমনসা ও বনের পরি – নাটক | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

বোকা কুমিরের কথা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

পেটকাটাও চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক বলেছিস চাঁদিয়াল, বিপদ এলে এমনি করে একসঙ্গে লড়াই না করলে কেউ বােধহয় নিস্তার পায় না । আমি ভয় পাচ্ছি না । একটুও না । আমিও লড়াই করছি ।

আকাশ থেকে নীচে তাকা । দ্যাখ, নীচের মানুষগুলাে কেমন উল্লাস করছে ! কে জিতবে কে হারবে । সেই নিয়ে ওরা গলা ফাটাচ্ছে । আমরা দুজনে কেউ কাউকে ছাড়ব না । আয় আমরা আরও ঘুরপাক খেয়ে আমাদের বাঁধন শক্ত করি । বলল চাঁদিয়াল ।

তারপরেই সেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল । সুতাে ছিঁড়ে সত্যি সত্যি উপড়ে গেল একসঙ্গে সেই দুটো ঘুড়ি, চাঁদিয়াল আর পেটকাটা । খুশিতে মাথা নাড়তে নাড়তে দুই বন্ধু যখন উড়ে যায়, তখন মাটির মানুষগুলাের উল্লাস থেমে গেছে । দুদলই তখন হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে । আর হয়তাে ভাবে, এ কেমন করে হয় ! দুদলই হেরে গেল !

হ্যাঁ, হেরে গেল । আর দ্যাখাে, ওই যারা জিতল, ওই দুই বন্ধু, পেটকাটা আর চাঁদিয়াল, কেমন আকাশে ভেসে যাচ্ছে, আনন্দে একসঙ্গে ! ভাসতে ভাসতে কোথায় যে হারিয়ে যাবে ওরা, আমরাও জানি না । জানে শুধু আকাশ । কেন না, আকাশ যে ওদেরও বন্ধু !

Read Also:

মাস্টারদা – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

মিষ্টি – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

তালনবমী – গল্প | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

একলা – কবিতা | পঞ্চম শ্রেণি | পাতাবাহার

আকাশের দুই বন্ধু গল্পের লেখক পরিচিতি:

শৈলেন ঘোষ (জন্ম ১৯২৮) : কৈশোরে ছোটোদের পত্রিকা ‘মাস পয়লা’য় প্রথম কবিতা লেখা । ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ শিশু নাটকটি সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে । তাঁর রচিত উপন্যাস- ‘মিতুল নামে পুতুলটি’ জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত । অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘আমার নাম টায়রা’, ‘গল্পের মিনারে পাখি’, ‘ভূতের নাম আক্কুশ’, ‘টুই টুই’ ইত্যাদি । এছাড়াও ছোটোদের জন্য অজস্র গল্প, ছড়া, নাটক রচনা করেছেন । উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলন – ‘হাসি ঝলমল মজা’, ‘স্বপ্ন দেখি রূপকথায়’, ‘ভালোবাসি পশুপাখি’, ‘গল্পের রং রকম রকম’ ।
পাঠ্য ‘আকাশের দুই বন্ধু’ গল্পটি তাঁর ‘স্বপ্ন দেখি রূপকথায়’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে ।

Follow us:

If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.

Leave a Reply