পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে কবি জসীমউদ্দিনের ‘চিঠি’ কবিতাটি দেওয়া হল ।
চিঠি – কবিতা
চিঠি পেলুম লাল মোরগের ভোর-জাগানোর সুর-ভরা
পাখার গায়ে শিশু ঊষার রঙন হাসি রঙিন করা ।
চিঠি পেলুম চখাচখির বালুচরের ঝিকিমিকি,
ঢেউ-এ ঢেউ-এ বর্ষা সেথা লিখে গেছে কত কী কী !
লিখে গেছে গাঙশালিকে গাঙের পাড়ের মোড়ল হ’তে,
জল-ধারার কল কল ভাসিয়ে আসর উজান সোঁতে ।
চিঠি পেলুম কিচিরমিচির বাবুই পাখির বাসার থেকে,
ধানের পাতায় তালের পাতায় বুনট-করা নকশা এঁকে ।
চিঠি পেলুম কোড়াকুড়ীর বর্ষাকালের ফসল-ক্ষেতে,
সবুজ পাতার আসরগুলি নাচছে জল-ধারায় মেতে ।
আকাশ জুড়ে মেঘের কাঁদন গুরু গুরু দেয়ার ডাকে,
উদাস বাতাস আছড়ে বলে কে যেন বা চাইবে কাকে ।
ইহার সাথে পেলুম আজি খোকা ভাই-এর একটি চিঠি,
শীতের ভোরের রোদের মতো লেখনখানি লাগছে মিঠি ।
দূর আকাশের সুনীল পাতায় পাখিরা সব ঝাঁকে ঝাঁকে
কত রকম ছড়ায় গড়ায়, মেঘের পাড়ায় পড়ায় কাকে ।
সেই সে পড়া হরফ-করা খোকা ভাই-এর রঙিন হাতে
খুশির নূপুর ঝুমুর-ঝামুর বাজছে আমার নিরালাতে ।
চিঠি কবিতার কবি পরিচিতি:
জসীমউদ্দিন (১৯০৪-১৯৭৬): জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলা । কুমুদরঞ্চন মল্লিকের পরে গ্রাম-বাংলাকে কেন্দ্র করে কাব্যচর্চার ধারাটি তিনিই বজায় রেখেছিলেন । একান্ত সহজ সরল ভাষায় পল্লী প্রকৃতির অনাড়ম্বর রূপটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন । তাই বাংলা কাব্যজগতে ‘পল্লী কবি’ হিসেবে অভিহিত । তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলি হলো রাখালী, নক্সী কাঁথার মাঠ, বালুচর, সোজন বাদিয়ার ঘাট, মাটির কান্না প্রভৃতি । তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাম্মানিক ডি. লিট. প্রাপ্ত হন ।
চিঠি কবিতার সারসংক্ষেপ:
কবি জসীমউদ্দিনের ‘চিঠি’ কবিতায় কবি বলেছেন, তিনি প্রকৃতি থেকে নানা ধরনের চিঠি পেয়েছেন । লাল মোরগের ভোর-জাগানো ডাকে যেন প্রকৃতি এক বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছে । সেই ডাকে শিশিরভেজা সকালের আলো আর উষার রঙিন হাসি ধরা পড়েছে । চখাচখির বালুচরে ঢেউয়ের খেলা আর বর্ষার জলে ভেসে আসা শব্দও কবির কাছে চিঠির মতো মনে হয়েছে । গাঙশালিকের ডাক আর গাঙের পাড়ে জলধারার কলকল শব্দও কবির কাছে এক আশ্চর্য বার্তা নিয়ে আসে ।
এছাড়া, কবি বাবুই পাখির বাসা থেকে চিঠি পেয়েছেন, যেখানে ধানের পাতায় আর তালের পাতায় আঁকা নকশার মতো সুন্দর বার্তা আছে । বর্ষাকালের সবুজ ক্ষেতে জলের সঙ্গে নাচতে থাকা পাতাগুলোও যেন প্রকৃতির পাঠানো এক আনন্দের বার্তা । আকাশে জমে থাকা মেঘের গুরু গুরু ডাক আর বাতাসের উদাস হাওয়া যেন কোনো অজানা প্রশ্ন বা অনুভূতির কথা জানাচ্ছে ।
এরপর কবি তার খোকা ভাইয়ের একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন । সেই চিঠি পড়ে কবির মনে শীতের সকালের রোদ্দুরের মতো মিষ্টি অনুভূতি হয় । খোকা ভাইয়ের চিঠি যেন দূরের আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের মনের কথা আর মেঘের পাড়ায় লেখা রঙিন বার্তা । সেই চিঠি কবির মনে খুশির ঝংকার তোলে এবং তার নিরালায় আনন্দের সুর বাজায় ।
এই কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের অনুভূতির গভীর সংযোগ এবং কবির মনে সৃষ্ট আনন্দের কথা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে । কবি দেখিয়েছেন, প্রকৃতি আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত বার্তা পাঠায়, যা আমাদের মনকে শান্তি ও আনন্দ দেয় ।
চিঠি কবিতার নামকরণের সার্থকতা:
কবি জসীমউদ্দিনের ‘চিঠি’ কবিতার নাম “চিঠি” খুবই সুন্দর ও অর্থবহ । এই কবিতায় কবি প্রকৃতি ও মানুষের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন বার্তা বা অনুভূতির কথা বলেছেন । কবি প্রকৃতির নানা উপাদান – লাল মোরগের ডাক, চখাচখির খেলা, বাবুই পাখির বাসা, বর্ষার মাঠের দৃশ্য, মেঘের ডাক – এসবকে চিঠির মতোই বিশেষ বার্তা হিসেবে কল্পনা করেছেন । এগুলো কবির মনে আনন্দ, শান্তি এবং নতুন অনুভূতি জাগিয়েছে ।
তাছাড়া, কবি তার খোকা ভাইয়ের লেখা একটি চিঠির কথাও বলেছেন, যা তার মনকে খুব খুশি করে । খোকা ভাইয়ের চিঠি যেন ভালোবাসা ও মধুর স্মৃতির প্রতীক ।
এইভাবে, প্রকৃতি এবং প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া বার্তা বা অনুভূতির কল্পনাকে “চিঠি” নামে প্রকাশ করা খুবই অর্থপূর্ণ । নামটি কবিতার মূল ভাবনাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে এবং পাঠকের মনে কৌতূহল জাগায় । তাই, “চিঠি” নামটি একদম উপযুক্ত ও সার্থক ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.