পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেনাপতি শংকর’ গল্পটি দেওয়া হল ।
সেনাপতি শংকর – গল্প
এখানে বাতাসের ভিতর সবসময় ভিজে জলের ঝপটা থাকে । মনে হবে কে যেন ভালো করে বেটে জলের মিহিদানা মিশিয়ে দিয়েছে । কারণ আর কিছুই নয় – পাঁচ-সাত মাইলের ভিতর বঙ্গোপসাগর । পাগলা বাতাসে তার ঢেউয়ের গুঁড়ো সবসময় উড়ে আসছে ।
আকন্দবাড়ি স্কুলের ক্লাস ফাইভে বিভীষণ দাশ এমু পাখির কথা বলছিলেন । প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্লাস । বইতে পাখির ছবি । কাছাকাছি ভেটুরিয়া, সাঁইবাড়ি, ঘোলপুকুর আর আকন্দবাড়ির জনা ত্রিশেক ছেলেমেয়ে বসে ।
স্কুলবাড়ির ছাদে টালি । মাটির দেয়াল । মাটির মেঝে । কাঠের বেঞ্চ । জানালায় কোনো শিক নেই । সেই জানালা দিয়ে মেঘ দেখা যায় আকাশের । দেখা যায় পাখি উড়ছে । সেদিকে তাকিয়ে একটি ছেলে আনমনা হয়ে পড়েছিল । নারকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে কত উঁচুতে ডানা মেলে শঙ্খচিল ভাসছে । এক-একদিন রাতে স্বপ্নের ভিতর সেও অমন ভেসে পড়ে । ঘোলপুকুরে গাব গাছের উঁচু ডাল থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে বড়োদিঘিতে । সিধে জলে না পড়ে সে পাখির মতো ভাসছে । ডানার বদলে দুই হাতে বাতাস কেটে । বাতাস যেন জল । পিছনে দু-পা ঠেলে দিয়ে আরও এগিয়ে যাচ্ছে । উঁচুতে । আরও উঁচুতে । অনেকটা ওই শঙ্খচিলদের মতোই ।
Read Also:
ভরদুপুরে – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
পাইন দাঁড়িয়ে আকাশে নয়ন তুলি – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
মন ভালো করা – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
পশুপাখির ভাষা – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
ঘাসফড়িং – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
কুমোরে পোকার বাসাবাড়ি – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
এই শংকর । শংকর-
চমকে উঠল ছেলেটি । এতক্ষণ যেন সে ক্লাসের বাইরে শঙ্খচিলদের সঙ্গেই আকাসে উড়ছিল । থতোমতো খেয়ে উঠে দাঁড়াল । হ্যাঁ মাস্টারমশাই-
বিভীষণ দাশ প্রায় ভেংচে উঠলেন, হ্যাঁ মাস্টারমশাই ! খুব মন পড়াশুনোয় ! চোখ কোন দিকে ছিল এতক্ষণ ? কী দেখছিলে ?
শংকর একদম চুপ । স্কুলের সামনে ধানক্ষেতে রোয়া ধান সবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । ঘন সবুজ । আর লাইন দিয়ে রোয়া । তার ওপর এইমাত্র একখানা মেঘের ছায়া পড়ল । ছায়া সরে যাচ্ছে । আর সেখানে রোদ এসে ঢুকছে ।
বিভীষণ দাশ চটে গিয়ে বললেন, কী দেখছিলে বাইরে ?
শংকর ঘাবড়ে গেল । শঙ্খচিল মাস্টারমশাই-আকাশে-
ওঃ ! শঙ্খচিল ! আমি কী পড়াচ্ছি বলো তো ?
এমু কথাটা একবার তার কানে ঢুকেছিল । শংকর তাই বুক ঠুকে বলছিল, এমু পাখি মাস্টারমশাই-
এমু পাখি দেখেছ কখনও ?
হ্যাঁ মাস্সাই- ।
এদিকে সবাই মাস্টারমশাই কথাটা তাড়াতাড়িতে বলে মাস্সাই ।
কোথায় দেখলে ?
ঘোলপুকুরে বড়োদিঘির পাড়ে – সবেদা গাছের ডালে এসে বসেছিল ।
সবেদা গাছের ডালে এসে বসেছিল ! কেমন দেখতে সে এমু পাখি ?
শংকর বুঝল, কোথাও একটা বড়ো ভুল হয়ে যাচ্ছে । তাই মাস্সাইয়ের কথায় ঠাট্টার সুর । তবু তার যেমন মনে পড়ল তেমনই সে বলল, খুব গাঢ় ছাই রং মাস্সাই । বাজপাখির চেয়েও বড়ো-চওড়া বুক-উড়ে গেলে ডানায় বাতাস কাটার শব্দ হয় জোরে-এমনি অন্য পাখিরা তখন ভয়ে সরে যায় ।
ভয়ে সরে যায় ? বলি এটা কি পঞ্চানন অপেরা পেয়েছ ? বানিয়ে বানিয়ে যে পার্ট বলে যাচ্ছ খুব !
সারা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল । বিভীষণ দাশ কড়া মাস্টারমশাই । গম্ভীর গলায় বললেন, এমু পাখির বাসস্থান আন্ডিজ পর্বতমালা । তিন বছরে একবার মোটে দুটো করে বড়ো বড়ো ডিম পাড়ে । সে কোন দুঃখে অত দূর দেশ থেকে ঘোলপুকুরের বড়োদিঘির পাড়ে সবেদা গাছের ডালে এসে বসবে ? আ্যাঁ ? আর এমু হলো গিয়ে দৌড়বাজ পাখি । খুব দৌড়ায় । উড়তেই পারে না । ঘোলপুকুরে তুমি এমু পেলে কোথেকে ? বলো । বলতেই হবে-
শংকর মুষড়ে পড়ল । কিন্তু তার মনে হচ্ছে – সে দেখেছে । ক্লাসসুদ্ধ সবাই ফিক ফিক করে হাসছে । কোথায় দেখেছে ? দেখে থাকতে পারে ? তবে কি প্রকৃতিবিজ্ঞান বইয়ের ছবিতে দেখল । না । তাহলে ? সাহস করে বলল, বলব মাস্সাই ?
বলো ।
তাহলে স্বপ্নে একদিন দেখেছি মাস্সাই । বেশ বড়ো সাইজের পাখি ।
সারা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল । হাসি থামাতে বিভীষণ দাশ বললেন, স্বপ্নে দেখেছ ?
হ্যাঁ মাস্সাই । নইলে আর কোথায় দেখব ? আপনি তো বললেন এমু পাখি থাকে আন্ডিজ পাহাড়ে । সে পাহাড় কোথায় আমি জানি না । স্বপ্নে আরও অনেক রকমের পাখি আসে মাস্সাই-
চুপ ! -বলে ধমকে উঠলেন বিভীষণ দাশ । তোমার বাবার নাম কী ?
আজ্ঞে অভিমন্যু সেনাপতি ।
তাকে আসতে বলবে কাল । আমি কথা বলব ।
বাবা তো আসতে পারবে না মাস্সাই-
কেন ?
বাবার খুব অসুখ ।
এমন সময় সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে সমীরকান্ত দীক্ষিত উঠে দাঁড়িয়ে হাসি চাপতে চাপতে বলল, ওর খুব পেট গরম মাস্সাই-তাই রোজ স্বপ্ন দেখে-
বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বিভীষণ দাশ জানতে চাইলেন, পেট গরম কেন ?
গাছে গাছেই সারাদিন থাকে । গাব, জাম, নোনা, ডাব খেয়ে খেয়ে বেড়ায় । পেট গরম হবে না তো কী ।
শংকর সেনাপতি আর বিশেষ কিছু বলতে পারল না । কী কুক্ষণেই যে সে ওদের স্বপ্নের কথা বলেছিল ।
স্বপ্ন তো সে সত্যিই দেখে । রোজই প্রায় দেখে । সেসব স্বপ্নে সে ওড়ে । পাখি হয়ে । আবার ধপ করে স্বপ্নের ভিতর সে খাট থেকে পড়েও যায় । পড়ে গিয়ে ঘুম ভাঙলে টের পায়-না, সে পড়েনি । বাঁ পায়ের শিরায় টান ধরেছে ।
স্বপ্নেই সে এমু পাখি দেখে থাকবে । গাঢ় ছাই রঙের বিরাট এক পাখি । ঘোলপুকুরে দিঘির পাড়ে সবেদা গাছের ডালে এসে বসেছিল । অনেকটা বাজপাখির মতো । তবে তার চেয়েও বড়ো । দূর থেকে কাকের দল চেঁচাচ্ছিল । পাখিটা উড়ে যেতে ডানায় বাতাস কাটার শব্দ হয়েছিল । অথচ বিভীষণ মাস্সাই বলছেন – এমু উড়তে পারে না- দৌড়োয়-দৌড়বাজ পাখি তো !
জেগে থাকতে দেখা আর স্বপ্নে দেখা জিনিস আজকাল শংকরের গুলিয়ে যাচ্ছে । স্বপ্নের দেখাকে মনে হয় জেগে থাকতে দেখেছি । জেগে থাকতে দেখা জিনিস মনে হয় স্বপ্নে দেখেছি ।
হঠাৎ বিভীষণ মাস্সাই চিৎকার করে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন ? বোসো ।
সঙ্গে সঙ্গে শংকর বসে পড়ল । সে তার স্বপ্নের কথা আর কাউকে কখনও বলবে না । বিশ্বাস করে বলার ফল তো এই । স্বপ্নে সে অনেক কিছু জানতে পেরেছে । যেমন স্বপ্নের বাতাসের রং নীলচে । বাড়ি-ঘরদোর খয়েরি রঙের । স্বপ্নে ধাক্কা খেলে কিংবা গুঁতো খেলে কোনো ব্যথাই লাগে না । অনেকটা যেন ঘোলপুকুরে বড়োদিঘিতে ডুব দিয়ে মাটি তোলার পর ভেসে ওঠার মতো । আপসে ভুস করে ভেসে ওঠা । জলের নীচে পোঁতা বাঁশে গা ঘষে গেলেও টের পাওয়া যায় না ।
বিভীষণ মাস্টারমশাই বলছিলেন, পাখি দেখার জন্য যখন মাঠে বা বাগানে ঘুরবে- তখন খুব সাবধানে পা টিপে টিপে চলবে- যেন পায়ের শব্দ না হয় । জামাকাপড়ের রং শুকনো পাতার রং বা জলপাই রঙের হলে ভালো । এই রং গাছের পাতার সঙ্গে মিশে থাকে । বেগুনি রঙের জামা পরলেও ভালো-পাখিরা বেগুনি রং দেখতে পায় না ।
তন্ময় হয়ে শুনছিল শংকর । হঠাৎ মাস্টারমশাই তার দিকে তাকিয়ে বললেন, শংকর সেনাপতি-
হ্যাঁ মাস্সাই বলে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল শংকর ।
তুমি তো গাছে গাছে ঘোরো-
একগাল হেসে ফেলল শংকর । তা মাস্সাই-
তুমি তো অনেকরকম পাখি দ্যাখো । তাদের কথা বলতে পারো ?
বিভীষণ মাস্সাই যে তাকে এমন একটা কথা বলবেন-তা ভাবতে পারেনি শংকর । সে লজ্জার সঙ্গে বলল, মাছরাঙা-
আর ?
হাঁড়িচাচা । ডৌখোল । পানকৌড়ি । তিতির মাস্সাই-
বাঃ ! যত পারবে চোখ খোলা রেখে এই পৃথিবীর পাখি, গাছপালা, মেঘ, আলো – সব দেখে নেবে ।
শংকরের বুকটা গর্বে ফুলে উঠল ।
বিভীষণ মাস্টারমশাই বললেন, এই খোলামেলা পৃথিবীই সবচেয়ে বড়ো বই । তাকে চোখ ভরে দেখাই সবচেয়ে বড়ো পড়াশুনো ।
সেনাপতি শংকর গল্পের লেখক পরিচিতি:
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৩–২০০১): জন্মস্থান অধুনা বাংলাদেশের খুলনা । বহুবিচিত্র জীবিকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই সাংবাদিক-লেখকের সব রচনাতেই সেই বিচিত্রতার স্বাদ পাওয়া যায় । বহু সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত এই লেখক ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শাহাজাদা দারাশুকো উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে – বেঁচে থাকার স্বাদ, ভাস্কো দা গামার ভাইপো, মনে কি পড়ে, কুবেরের বিষয়আশয়, ঈশ্বরীতলার রুপোকথা, ক্লাস সেভেনের মিস্টার ব্লেক ৷ বর্তমান রচনাংশটি তাঁর সেনাপতি শংকর গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.