পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক সুবিনয় রায়চৌধুরীর ‘পশুপাখির ভাষা’ গল্পটি দেওয়া হল ।
পশুপাখির ভাষা – গল্প
‘পশুপাখির কি ভাষা আছে ? তারা কি মনের ভাবগুলি বিশেষ বিশেষ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে ? পরস্পরকে বুঝাবার জন্য তারা কি কোনো ভাষা ব্যবহার করে ?’ – এইসব প্রশ্ন মানুষের মনে বহুকাল থেকেই জেগেছে এবং এই বিষয়ে নানারকমের পরীক্ষা বহুকাল থেকে হয়ে আসছে ।
পশুপাখিরা অবিশ্যি মানুষের অনেক কথারই অর্থ বোঝে । বুদ্ধিমান জীব – যেমন কুকুর, বনমানুষ, ঘোড়া প্রভৃতি – তাদের মানুষে-দেওয়া নাম শুনলেই কান খাড়া করে; – নাম ধরে ডাক দিলে কাছে আসে । মুরগিরা ‘তি-তি’ ডাক শুনে আসে, হাঁস ‘সোই-সোই’ ডাক শুনে আসে, ছাগল ‘অ-র্-র্’ ডাক শুনে আসে । হাতি তো মাহুতের কথা শুনেই চলে । মাহুতের ভাষায় (পূর্ববঙ্গের) ‘বৈঠ’ হচ্ছে ‘বস’, ‘তেরে’ মানে কাত হও, ‘ভোরি’ মানে ‘পিছনে যাও’, ‘মাইল’ মানে সাবধান ইত্যাদি । কুকুরেরাও কথা শুনে হুকুম পালন করতে ওস্তাদ; – অবিশ্যি, সে-সব কথার অর্থ তাদের শেখাতে হয় ।
পশুরা মানুষের ভাষা কিছুকিছু বোঝে বটে; কিন্তু, সে ভাষা তো তারা বলতে পারে না; পরস্পরকেও সে ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার কোনো উপায় জানে না তারা । তাদের মুখের কয়েকটি বিশেষ শব্দ যে তাদের মনের ভাবকে প্রকাশ করে, সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই । বেড়াল বা কুকুর ঝগড়া করার সময় যে শব্দ করে, কান্নার সময় সে শব্দ করে না । দূর থেকে শুনেই বোঝা যায় ঝগড়া করছে কী কাঁদছে । কুকুরের ঝগড়া আর রাগের শব্দে ‘ঘেউ’ আছে; ভয় বা কান্নার শব্দে ‘কেঁউ’ আছে । জাতভেদে শব্দের টানে আর গাম্ভীর্যে যা একটু তফাত । বেড়ালেরও তেমনি সাধারণ আওয়াজে ‘ম্যাও’, ‘মিউ’ ইত্যাদি আছে; রাগ বা ঝগড়ায় ‘ওয়াও’ আছে । দূর থেকে শব্দ শুনেই বোঝা যায় ঝগড়া করছে কী কাঁদছে । কী শুধু আওয়াজ করছে- অর্থাৎ, তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে । অনেক পশুই এই ধরনের শব্দ করে থাকে । পাখিরাও ভয়, রাগ প্রভৃতি প্রকাশ করবার জন্য বিশেষ বিশেষ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে । বিপদের সময় পরস্পরকে জানাবার উপায়ও পশুপাখিরা বেশ জানে ।
রিউবেন ক্যাস্টাং নামে একজন সাহেব বহুকাল পশুদের সঙ্গে ভাব পাতিয়ে বেড়িয়েছেন । তিনি বলেন, ‘আমি পশুর ভাষা বেশ বুঝি । কতবার আমি জংলি হাতির সামনে পড়েছি, বাঘের গরম নিশ্বাস অনুভব করেছি, প্রকাণ্ড ভাল্লুকের থাবা মুখের সামনে দেখেছি, গরিলা প্রায় জড়িয়ে ধরে ফেলেছে আমাকে । কিন্তু একটি জিনিস প্রত্যেকবারই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, – সেটি হচ্ছে, পশুদের ভাষার জ্ঞান । আমি পশুদের ভাষা কিছুকিছু জানি বলেই এতবার সাক্ষাৎ যমকে এড়িয়ে যেতে পেরেছি ।’
Read Also:
ভরদুপুরে – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
সেনাপতি শংকর – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
পাইন দাঁড়িয়ে আকাশে নয়ন তুলি – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
মন ভালো করা – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
ঘাসফড়িং – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
কুমোরে পোকার বাসাবাড়ি – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
তিনি আরও বলেন, ‘সিংহকে যদি তারই ভাষায় বলতে পারো, তুমি তার বন্ধু, তাহলে অনেকটা নিরাপদ হবে । তারপর যদি তাদের জাতের আদবকায়দা অনুসারে তার কাছে যেতে পারো, তাহলে ভয়ের বিশেষ কোনো কারণ থাকবে না ।’
ক্যাস্টাং সাহেব প্রায় চল্লিশ বছর বন্যজন্তুদের সঙ্গে থেকেছেন । খাঁচার এবং জঙ্গলের, – অর্থাৎ পোষা এবং বুনো এই দুই অবস্থার জন্তুদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয়ের নানা সুযোগ ঘটেছে । তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, সিংহ, গ্রিজ্লি ভাল্লুক আর শ্বেত ভাল্লুক ।
তিনি বলেন, ‘এইসব পশুর গলার শব্দের অবিকল নকল করার ক্ষমতা থাকায় শুধু যে বহুবার আমার প্রাণ বেঁচেছে, তা নয়; এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবারও অনেক সুবিধা হয়েছে । পশুরা শুধু শব্দের সাহায্যে কথা বলে না, নানারকম ইশারায়ও বলে । কুকুরের লেজনাড়া আর কান নাড়ার মধ্যে কত অর্থ আছে, তা অনেকেই আমরা জানি । একেও ভাষা বলতে হবে ।’
পোষা জন্তুরা নাকি জঙ্গলের জন্তুদের থেকে অনেক বেশি চেঁচামেচি করে । পোষা কুকুর আর ঘোড়া কত চেঁচায় । কিন্তু জংলি কুকুর বা ঘোড়ার শব্দ বড়ো একটা শোনা যায় না । জঙ্গলের পশুকে সর্বদাই প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে হয়, তাই তারা স্বভাবতই নীরব ।
পশুর মধ্যে শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং জাতীয় বনমানুষের ভাষা বিশেষ কিছু নাই । বানরের মধ্যে কয়েক জাতীয় বড়ো বানর ছাড়া অন্য সকলের ভাষার শব্দ অতি সামান্যই । ক্যাস্টাং সাহেব এইসব ভাষা নিয়ে বহু বৎসর গবেষণা করেছেন ।
তিনি বলেন, ভালো করে লক্ষ করলে পশুদের মনের বিভিন্ন অবস্থার আওয়াজগুলি বেশ স্পষ্টভাবে ধরা যায় । এইসব আওয়াজের অবিকল নকল করতে শিখলে পশুদের সঙ্গে ভাব পাতাবারও সুবিধা হয় ।
ক্যাস্টাং সাহেব বলেন, হাতি, সিংহ, বাঘ আর শ্বেত ভাল্লুকের কয়েকটির গায়ে হাত দেওয়ার আগে বিশেষ করে লক্ষ করতে হবে, তোমার আওয়াজের জবাব সে দিচ্ছে কিনা । তারপর, খুব সাবধানে, অত্যন্ত ধীরে এগিয়ে, মেজাজ বুঝে, তার গায়ে হাত দিতে হবে । বাঘের চেয়ে চিতা ঢের সহজে ভাব পাতায় আর পোষও মানে । তার মুখটি দেখলেই অনেকটা বেড়াল-বেড়াল ভাব মনে আসে ।
ভাল্লুক নিরামিষাশী আর লোভী; তাকে খাবার দিলেই সে সহজে ভাব পাতায় । আমিষাশী জন্তু কিন্তু কখনও খাবারের লোভে ভাব করে না । খাবার সময় তার কারো সঙ্গে ভাব নাই;-তখন সকলকেই অবিশ্বাস ।
শিম্পাঞ্জি, ওরাং এদের বিষয় কিছু লেখা হয়নি । এরা তো মানুষেরই জাতভাই; কিন্তু ভাষা এদের বড়ো একটা নাই । ভালোবাসা, সহানুভূতি প্রভৃতি এরা খুব বোঝে; ভাবও পাতায় সহজেই । এদের মনের ভাবই মুখে বেশি প্রকাশ পায় । গরিলাও এদের জাতভাই; সেও অনেকটা এদের মতো; তবে একটু কম চালাক ।
পশুপাখির ভাষা গল্পের লেখক পরিচিতি:
সুবিনয় রায়চৌধুরী (১৮৯০-১৯৪৫): প্রখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র । তিনি হারমোনিয়াম, এসরাজ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন । সংগীতে তাঁর জ্ঞান ছিল সুবিদিত । তিনি একান্তভাবে ছোটোদের জন্যই লিখেছেন । একদিকে সহজ-সরল ভাষায় মজাদার গল্প-কবিতা যেমন লিখেছেন অজস্র, ঠিক তেমনই শিশু-কিশোর মনের জিজ্ঞাসা মেটাতে প্রাঞ্জল ভাষায় তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধও রচনা করেছেন । সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর বিপুল অবদান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে । তাঁর উল্লেখযোগ্য বই সুবিনয় রায়চৌধুরীর রচনা সংগ্রহ ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.