পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মরশুমের দিনে’ গল্পটি দেওয়া হল ।
মরশুমের দিনে – গল্প
ছোটো মফস্সল শহর । ডিপোয় বাস দাঁড়িয়ে । ধরাধরি করে ছাদে মাল তুলছে বাসের কনডাক্টর আর ক্লিনার । বাস যাবে দূরের শহরে কী গঞ্জে । সারা পথ সকলে যাবে না । গ্রামের যাত্রীরা নেমে নেমে যাবে মাঝরাস্তায় । কারও বা কোর্টে মামলা ছিল । কেউ বা এসেছিল সরকারি সেরেস্তায় হাকিমের কাছে দরবার করতে । কারও শক্ত রোগী আছে হাসপাতালে, দেখতে এসেছিল । কেউ এসেছিল দোকানের জন্য মাল তুলতে । ভিতরে নিজের নিজের জায়গায় হাতের জিনিস রেখে অনেকেই বাইরে এসে দাঁড়ায় । সামনেই চায়ের দোকানে বেঞ্চির ওপর বসে ড্রাইভার চা খায় । সেদিকে নজর রেখে যাত্রীর দল কাছেপিঠে ঘুরঘুর করে । গরমের সময় গায়ে হাওয়া লাগায়, শীতের সময় রোদ পোহায় ।
বাসে ভিড় দেখতে হয় মাঠে ফসল উঠলে । মেয়ে দেখতে, পুজো দিতে লোকে এখানে সেখানে যায় । জিনিস কিনতে, সিনেমা দেখতে, মামলার তদবির-তদারক করতে শহরে যায় । উকিল-মোক্তার, বামুন-পুরুত, দরজি-দোকানি দুটো পয়সার মুখ দেখে । গ্রামের সঙ্গে শহরের যে এখনও নাড়ির টান, এই সময়টা তা বিলক্ষণ বোঝা যায় ।
ধন বলতে ধান । কথাটা আজও সত্যি । ধানের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু বৃষ্টি । মাটি দেয় ফসল, আকাশ জল । ফসল আর জলবৃষ্টির কামনা করেই লোকের সারা বছর কাটে ।
দেশি মতে আগে বছর শুরু হতো জলবৃষ্টি আর ফসলের সময় থেকে । মাসের নাম আর খতুর নামের মধ্যে আজও তার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় ।
আগে বছর আরম্ভ হতো অগ্রহায়ণে । হায়ন মানে বছর । অগ্রহায়ণ মানে বছরের গোড়া । হায়ন কথাটার আর এক মানে ফসল ।
বছরকে আমরা বলি ‘বর্ষ’ । জলবৃষ্টির সময় এককালে বছর শুরু হতো বলে মরশুমের নাম হয়েছিল ‘বর্ষ’ । এদেশের যত পালা-পার্বণ, উৎসব-আনন্দ, সব কিছুরই মূলে রয়েছে চাষবাস ।
শহর ছাড়ালেই দু-পাশে দেখা যাবে মাথার ওপর দরাজ আকাশ । বাস-রাস্তার দু-ধারে বটপাকুড় শাল সেগুনের গাছ । তার ডালে দৃষ্টি মাঝে মাঝে আটকে যাবে । কালো কুচকুচে বাঁধানো রাস্তা । মাঝে মাঝে বাঁক নিয়ে সোজা সামনে চলে গেছে ।
গরমকালে চারদিকে হাওয়া যখন আগুনের মতো তেতে থাকে, তখন এই রাস্তার ওপরই এক ভারি মজার দৃশ্য দেখা যায় । যেতে যেতে মনে হয়, দূরে যেন জল চিকচিক করছে । আর সেই জলে উলটো হয়ে পড়েছে দু-পাশের গাছের ছায়া । কাছে যাও । কোথায় জল, কোথায় ছায়া ! ঠিক মরুভূমির মরীচিকার মতো ।
বাস রাস্তার ধারে ধারে মাঝে মাঝে লোকালয় | বড়ো গ্রাম হলে ইটের দালান দেখা যাবে। নইলে
মাটির বাড়ি। খড় কিংবা টিনের চাল। লোকালয় পার হলেই আবার আদিগন্ত মাঠ। একেক খতুতে তার
একেক চেহারা।
শরতে দেখবে যতদূর দৃষ্টি যায় নীলরঙের আকাশটাকে কেউ যেন ঝকঝকে তকতকে করে মেজে রেখেছে । মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই । রোদ যেন কাঁচা সোনার মতো । নীচে কোথাও মাটি দেখা যাচ্ছে না । সামনে পিছনে একটানা সবুজ ধান । সমুদ্রের মতো তার পার দেখা যায় না । তার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে ঢেউ খেলে যায় হাওয়ায় । দূরে দূরে জেগে থাকে একটা দুটো তালখেজুর কিংবা শিশুপলাশ ।
ধানকাটার পর একেবারে আলাদা দৃশ্য । যতদূর দৃষ্টি যায় রুক্ষ মাটি । শুকনো কঙ্কালসার চেহারা । আলগুলো জেগে থাকে বুকের হাড়পাঁজরের মতো । মাঠের ভিতর দিয়ে পায়ে পায়ে রাস্তা ফুটে ওঠে গ্রামে যাওয়ার । আকাশের রং তখন তামার হাঁড়ির মতো । রোদের দিকে তাকানো যায় না । গোরুর গাড়ির চাকায়, মানুষের পায়ে মাটির ডেলাগুলো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলো হয় । সেই ধুলো কখনও ঘুর্ণি হাওয়ায় কখনও দমকা হাওয়ায় উড়ে উড়ে দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়ায় । একটু বেলা হলেই মাটি তেতে আগুন হয়ে ওঠে । যারা হালবলদ নিয়ে ভোরে মাঠে গিয়েছিল, বেলা বাড়লেই তারা যত তাড়াতাড়ি পারে ঘরে ফিরবে । নদী পুকুর খাল-বিল শুকিয়ে যায় । গাছে পাতা থাকে না । খাল-বিল নদী-নালার ধারে ধারে ছাড়া কোথাও ঘাসের ডগা দেখা যায় না । রাখালের দল ছড়ি-পাঁচন হাতে বটঅশথের ছায়ায় বসে থাকে । মাঝে মাঝে হাওয়ায় আগুনের হলকা দেয় । জলের জন্য চারিদিকে হাহাকার পড়ে যায় । লোকে সেইসময় ছায়া খুঁজে খুঁজে যাবে । পায়ে চলা রাস্তা যাবে বটঅশথের তলা দিয়ে, আমকাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় । বাঁধানো ইঁদারা, নদীনালা, তালপুকুরের ধার দিয়ে দিয়ে । যেখানে হাতের কাছে পিপাসার জল পাওয়া যাবে ।
আকাশের জল চেয়ে বসুধারা ব্রত করবার এই হলো সময় । কেন-না এখন :
কালবৈশাখী আগুন ঝরে !
কালবৈশাখী রোদে পোড়ে !
নদী শুকু শুকু, আকাশের ছাই !
কোথাও বা চাষির ঘরের বউরা করে ক্ষেত্রব্রত । তারা যায় বাড়ির কাছের খোলা জমিতে । নিজেরা ঘট প্রতিষ্ঠা করে তার গায়ে সিঁদুর-পুত্তলি এঁকে ঘটের জলে আমের পল্লব ডুবিয়ে দেয় । বুড়িদেরই কেউ হয় মূলব্রতী । হাতে ফুল আর দূর্বা নিয়ে ব্রতীর দল তার মুখ থেকে শোনে ব্রতের কথা । সন্ধে নাগাদ উলু দিয়ে ব্রত শেষ হয় । তারপর মাঠে বসেই চিঁড়ে-গুড়-মুড়ি-খই আর দই দিয়ে ফলার খায় । ছেলেরাও ওইদিন ভোরে একজন কারো মাঠে গিয়ে জমিতে লাঙল দিয়ে বীজধান পুঁতে জমিতে জল ছড়িয়ে আসে ।
কোথাও আছে বৃষ্টির অভাবে ‘মেঘারানির কুলো’ নামাবার প্রথা । কুলো, জল ঘট নিয়ে চাষিঘরের অল্পবয়সি মেয়েরা দলে দলে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ে । বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গায় । গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে তারা পায় চাল-তেল-সিঁদুর, কখনও দু-চারটে পয়সা আর পান-সুপারি । দল বেঁধে তারা গায় :
হ্যাদে লো বুন মেঘারানি
হাত পাও ধুইয়া ফেলাও পানি ।
ছোটো ভুঁইতে চিনচিনানি
বড়ো ভুঁইতে হাঁটুপানি ।
মেঘারানির ঘরখানি পাথরের মাঝে
হেই বৃষ্টি নামে লো ঝাঁকে ঝাঁকে ।
কালা মেঘা ধলা মেঘা বাড়ি আছনি ?
গোলায় আছে বীজধান, বুনাইতে পারোনি ?
মেঘকে নামাবার জন্য তারা নানা লোভ দেখায় :
কালো মেঘা নামো, ফুলতোলা মেঘা নামো
ধুলোট মেঘা, তুলোট মেঘা, তোমরা সবাই নামো ।
কালো মেঘা টলমল, বার মেঘার ভাই
আরও ফুটিক জল দিলে ফুটিক চিনার খাই ।
কালো মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া
তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া ।
আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি
নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি ।
কৌটা ভরা সিঁদুর দিব সিঁদুর মেঘার গায়
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায় ।
কখনো-কখনো হঠাৎ বিকালের দিকে আকাশ কালো হয়ে আসে । ঝিম-ধরা আকাশে দেখা দেয় বেগবান মেঘ । মেঘের কোলে চমকাতে থাকে বিদ্যুৎ । তারপর নারকেল-তাল-খেজুর গাছের মাথাগুলোকে হেলিয়ে দিয়ে নেমে আসে আচমকা ঝড় । জলের বড়ো বড়ো ফোঁটা তপ্ত মাটিতে পড়তে না পড়তে মিলিয়ে যায় । মেঘ যতই ডাকুক, যত গর্জায় তত বর্ষায় না । কখনো-কখনো শিলাবৃষ্টি হয় । মুহূর্তের মধ্যে জুড়িয়ে যায় গ্রীষ্মের তাপ । ছেলেরা হই হই করে ছোটে আমবাগানে । অন্ধকার হলে সঙ্গে হারিকেন নেয় । সুর করে করে বলে :
ঝড় ঝড় ঝড়
একটি আম পড় ।
একটি আম পড়িসনে কো
তলা বিছিয়ে পড় ।
খুকু খাবে পেট ভরে
নিয়ে যাবে ঘর ।।
হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায় মেঘ । বৃষ্টি আসি আসি করেও আসে না । আকাশ আগের অবস্থায় আবার ফিরে যায় । তবু বর্ষায় মরশুমের জন্য এখনই তৈরি হতে হয় । সারা গ্রামে চলে বর্ষার প্রস্তুতি ।
হঠাৎ একদিন ঝমঝম করে পড়ে বৃষ্টি । গরম মাটিতে জল পড়ে ভাপ ওঠে । চাষিদের মুখে হাসি ফোটে । ছোটো ছোটো ছেলেরা আনন্দে দুলে দুলে ছড়া বলে : ‘আয় বৃষ্টি বেঁপে, ধান দেব মেপে ।’ ছোকরার দল দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে প্রথম বৃষ্টিতে হই হই করে ভেজে । মাটির সোঁদা গন্ধে চারদিক ভরে ওঠে । বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে অন্য সমস্ত আওয়াজ ডুবে যায় । বৃষ্টির ছন্দে ছেলেরা ছড়ার ঝুলি উপুড় করে দেয় । সুর করে করে বলে :
ওপারেতে কালো রং
বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম ।
এ পারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে –
গুণবতী ভাই আমার, মন কেমন করে ।
তারপর ক-দিন সমানে বৃষ্টি । হোগলার তৈরি মাথালে মাথা পিঠ ঢেকে দুরন্ত জলের মধ্যেই গামছা পরে চাষিরা বেরিয়ে পড়ে মাঠের কাজে । ধান রোয়া, আল বাঁধার কাজ এখনই সেরে ফেলতে হবে । ধান ছাড়াও কারো আছে পাটের জমি । তারও বিস্তর কাজ ।
গ্রামদেশে বনে বনে ফুল ফুটিয়ে বসন্ত কবে আসে কবে যায় ভালো করে ঠাহরই পাওয়া যায় না দক্ষিণের হাওয়াই শুধু বসন্তকে মনে পড়িয়ে দেয় । কিন্তু বর্ষা নামলে একবার শুধু বাইরে এসে দাঁড়াও যেখানে ঘাসের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না, হঠাৎ চোখে পড়বে সেখানে যেন কে সবুজ জাজিম পেতে
রেখেছে । জমিতে ধান ডিগডিগ করে বেড়ে ওঠে । মাঝে মাঝে নিড়িয়ে দিতে হয় মাঠ । কিছু দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় মাঠের কাজ । তখন শুধু ফসলের অপেক্ষায় বসে থাকা ।
বর্ষার শেষাশেষি মেয়েরা করে ভাদুলি ব্রত । মাটিতে আঁকে আলপনা : সাত সমুদ্র । তেরো নদী । নদীর চড়া । কাঁটার পর্বত । বন । ভেলা । বাঘ । মোষ । কাক । বক । তালগাছে বাবুইয়ের বাসা । – এ ব্রত সেইদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন এদেশে সওদাগররা সাতডিঙা ভাসিয়ে সমুদ্রে বাণিজ্যে যেত । ব্রতের ছড়ায় আজও সে ছবি ধরা আছে । ‘বাপ গেছেন বাণিজ্যে, ভাই গেছেন বাণিজ্যে, সোয়ামি গেছেন বাণিজ্যে’ – তারা যেন নিরাপদে ফিরে আসে । ভাদ্রের ভরা নদীকে ডেকে দুরুদুরু বক্ষে তারা ব্যগ্রতা জানায় :
নদী ! নদী ! কোথায় যাও
বাপ ভাইয়ের বার্তা দাও ।
নদী ! নদী ! কোথায় যাও
স্বামী-শ্বশুরের বার্তা দাও ।
আজ সেই সওদাগরও নেই, সেই বাণিজ্যও নেই । কিন্তু এই ব্রতের ভিতর দিয়ে মনে পড়ে যায় সেই আপনজনদের কথা, যারা দূরে আছে ।
মরশুমের দিনে গল্পের লেখক পরিচিতি:
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩): বাংলা কবিতায় এক উল্লেখযোগ্য নাম কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় । ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক প্রকাশিত হয় । তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে অগ্নিকোণ, চিরকুট, ফুল ফুটুক, যত দূরেই যাই, কাল মধুমাস, ছেলে গেছে বনে, জল সইতে, প্রভৃতি । তিনি হাফিজ, নাজিম হিকমত ও পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদ করেছেন । সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর গদ্য রচনার দৃষ্টান্ত কাঁচা-পাকা, ঢোল গোবিন্দের আত্মদর্শন প্রভৃতি গ্রন্থে ছড়িয়ে রয়েছে । পাঠ্য রচনাংশটি তাঁর নারদের ডায়েরি নামক বইয়ের মরশুমের দিনে রচনার অংশবিশেষ ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.