পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক তপন করের ‘মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র’ গল্পটি দেওয়া হল ।
মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র – গল্প
দেয়ালচিত্র এঁকে থাকেন সাধারণত গ্রামের মেয়েরাই । সেই চিত্রণের বিষয়বস্তু যেমন নিজেরা নির্বাচন করেন, তেমনি তার উপাদানও নিজেরাই সংগ্রহ করেন । আর এর জন্য প্রয়োজনীয় সময়ও তারা বের করে নেন সংসারের নিজস্ব নিয়মিত কাজগুলির মধ্যেই ।
লোকে যাকে চলতি ভাষায় পুরুল্যা বলেন, সাধুভাষায় বলেন পুরুলিয়া, সেই জেলাকে কেন্দ্র করে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে লোকসমাজে দেয়ালে ছবি আঁকার চল আছে । পূর্বতন মানভূম জেলার ভৌগোলিক সীমানাটিকে বাংলার দেয়ালচিত্র চর্চার পীঠস্থান বলা যায় । এর সঙ্গে সংলগ্ন জেলা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান জেলার পশ্চিম অংশ, বীরভূম জেলাতে প্রচুর দেয়ালচিত্রণ হয়ে থাকে ।
মানভূমে সাঁওতাল, হো, অসুর, ভূমিজ, মুন্ডা, ওঁরাও, খেড়িয়া, শবর, কোল, বীরহড় প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস থাকলেও এদের মধ্যে মাটির ঘর তৈরি তথা দেয়ালচিত্রের ক্ষেত্রে সাঁওতালরাই অগ্রসর । পাশাপাশি ভূমিজ ও খেড়িয়াদের চিত্রণও যথেষ্ট উন্নত ।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই মাটি সুলভ হওয়ায় মানুষ গৃহনির্মাণের প্রধান উপকরণ হিসাবে মাটিকেই বেছে নিয়েছে । মাটির ঘরের দেয়ালের এই চিত্রণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এগুলি অস্থায়ী । সাধারণত আশ্বিনের দুর্গাপূজা ও কার্তিকের অমাবস্যা বা দীপাবলি, এই দুই উৎসবকালকে উপলক্ষ করে দেয়ালচিত্রগুলি রচিত হয় । চিত্রণগুলি গৃহের সৌন্দর্যের জন্য অলংকার হিসেবে করা হয় । সাধারণভাবে লালচে ‘গিরিমাটি’ বা গৈরিক বর্ণের মৃত্তিকায় ‘গিরিফল’ চুবিয়ে গৃহদ্বারের শীর্ষে ও দুইপাশে ছাপ দেওয়ার প্রথা বাংলার কৃষিজীবী সমাজে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় ।
সাঁওতাল ভূমিজ, মাহাত বা কুর্মি, বাউরি, শবর ইত্যাদি গোষ্ঠীগুলি কালীপূজা অর্থাৎ কার্তিকের অমাবস্যাকেই গৃহ-মার্জনা ও অলংকরণের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন । এই তিথিতেই রাঢ়বঙ্গের কৃষিজীবী সমাজের প্রাচীন উৎসব গো-বন্দনা, অলক্ষ্মী বিদায়, কাঁড়াখুটাঁ, গোরুখুঁটা প্রভৃতি পালিত হয় । সমগ্র ঘর-বাড়ি মেরামতি, লেপা-মোছা করার পর গৃহাঙ্গনের প্রবেশদ্বার থেকে উঠান, গোহাল, ধানের গোলা বা মরাই এবং মূল বাসগৃহ, সর্বত্র আলপনা দিয়ে সাজানো হয় ।
মূলত জ্যামিতিক আকার-আশ্রিত বর্ণ সমাবেশেই রচিত হয় সাঁওতালি দেয়ালচিত্র । এতে যেমন দেখা যায় চওড়া রঙিন ফিতের মতো সমান্তরাল রেখা তেমনি থাকে চতুষ্কোণ ও ত্রিভুজের ছড়াছড়ি । চতুষ্কোণের ভিতর চতুষ্কোণ বসিয়ে করা হয় নকশা কিংবা ত্রিভুজের ভিতর বসানো হয় আরও ত্রিভুজ । সাধারণত ঘরের চতুষ্পার্শ্ব ঘিরে থাকা মূল বেদিটিকে করা হয় কালো । তার সমান্তরালে টানা হয় বিঘতখানেক চওড়া গেরুয়া রঙের একটি রেখা, আবার তার উপর সমান ছাড় দিয়ে আর একটি সমান্তরাল কালো রেখা । এর উপরে সাদা, আকাশি, গেরুয়া বা হলদে রঙের রেখা দিয়ে চতুষ্কোণ বা ত্রিভুজগুলি হতে পারে । সেগুলি পাশাপাশি বসে দেয়ালটিকে ভরিয়ে তোলে । সাধারণত এভাবে মাটি থেকে ছ-ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় চিত্রণটি বিস্তৃত হয় ।
সাঁওতাল ব্যতীত অন্যদের মধ্যে ভূমিজ, কুর্মি বা অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষেরা যে চিত্রণ করে থাকেন তার সাধারণ লক্ষণ হল পদ্ম । একটা বৃত্তের পরিধিতে যেকোনো বিন্দুকে কেন্দ্র করে আরেকটি বৃত্ত টানলে পরিধির উপর যে ছেদবিন্দুদ্বয় পাওয়া যায় তার উপর পুনরায় কেন্দ্র করে ক্রমাগত বৃত্ত টানতে থাকলে ক্রমে একটি পদ্মের রেখাচিত্র পাওয়া যায় । এই পদ্মের পাপড়িগুলি বিচিত্র বর্ণে ভরে দেওয়া হয় । কখনো কখনো দেখা যায় একটা টব বা কলস থেকে ফুলের গাছটি উঠে আসছে এবং দু-পাশে শাখা ছড়িয়ে শাখার আগায় ফুল ফোটাচ্ছে । সেখানেও বিকশিত পুষ্পটি শতদল বলেই বোঝা যায় । এই পদ্মটিকে মানভূমী দেয়ালচিত্রের প্রতীক বলা হয় ।
এর পাশাপাশি অপর যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলো ‘মোরগঝুঁটি’ । এটি খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষত্বপূর্ণ । যখন মোরগঝুঁটিকে চালচিত্রের মধ্যে স্থাপন করে অন্যান্য মোটিফ সংযুক্ত করে জড়োয়া সাজ করা হয় তখন বলা হয় মোরগঝুঁটির ঝাড় বা মুরগা ঝাড় । চালচিত্রটির ধারে ধারে সারিবদ্ধ থাকে উদীয়মান সূর্যের নকশা । সূর্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসে একটি করে আধফোটা পদ্ম । এর বাইরে যে শূন্যস্থান পড়ে থাকে সেখানে বসানো হয় নানারকমের ছোটো ছোটো মোটিফ । সেগুলির মধ্যে পদ্ম তো থাকেই, তার সঙ্গে ইস্কাবন, হরতনের চিহ্ন ও সাধারণ লতাপাতা, পাখি, ময়ূর ইত্যাদিও থাকে । উল্লেখ্য, এই ধরনের বিস্তৃত আকারের ছবি যেমন লাল, নীল, সাদা, গেরুয়া ইত্যাদি বিচিত্র বর্ণের সমাবেশ আঁকা হয়, তেমনি বর্ণ ছাড়াও আঁকা হয় ।
অত্যন্ত মসৃণভাবে নিকানো দেয়ালে অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের বেলেমাটির গোলা দিয়ে নাতা দেওয়া হয় । এই মাটির রং ঈষৎ হরিদ্রাভ ও সাদাটে । সাদাটে বলেই এ মাটির স্থানীয় নাম ‘দুধেমাটি’ । এই মাটির প্রলেপটি ভিজে থাকতে থাকতেই এর উপর হাতের আঙুলের ডগা দিয়ে দাগ টেনে এঁকে দেয় ছবি ।
বিষয় হিসেবে পূর্বে বর্ণিত মোরগঝুঁটির ঝাড় তো থাকেই, তার সঙ্গে ‘কদমঝাড়’ ‘শালুকলতা’-ও প্রায়শ চোখে পড়ে ।
এই চিত্রকলা কোনো গোপন স্থান বা আড়ালে করার রীতি নেই, বরং দূর থেকে দৃশ্য হিসেবে মানানসই হবে এমনভাবেই দেয়াল নির্বাচন করা হয় ।সেজন্য শুধু বাসগৃহের দেয়াল নয়, প্রাচীরগাত্র কিংবা অন্য যেকোনো রকম ঘরের দেয়ালও নির্বাচিত হয় ।
Read Also:
মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র – প্রশ্ন ও উত্তর | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র গল্পের লেখক পরিচিতি :
তপন কর (জন্ম ১৯৫৪) : হাত্তড়ায় বাসবাস করেন । সরকারি চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে স্নাতক হন । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে সরকারি বিদ্যালয়ের শিল্প শিক্ষক । তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য বই – অসামান্য মানভূম, ছবি আঁকতে শেখা প্রভৃতি । মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র রচনাংশটি লেখকের মাটির ঘরে দেয়ালচিত্র প্রবন্ধের একটি সংকলিত ও সংক্ষেপিত অংশ ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.