পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘কুমোরে পোকার বাসাবাড়ি’ গল্পটি দেওয়া হল ।
কুমোরে পোকার বাসাবাড়ি – গল্প
আমাদের দেশে ঘরের আনাচে-কানাচে বা দেয়ালের গায়ে লম্বাটে ধরনের এবড়ো-খেবড়ো এক-একটা শুকনো মাটির ডেলা লেগে থাকতে দেখা যায় । সেগুলি একপ্রকার কালো রঙের লিকলিকে কুমোরে-পোকার বাসা । এই পোকাগুলির গায়ের রং আগাগোড়া মিশমিশে কালো । কেবল শরীরের মধ্যস্থলের বোঁটার মতো সরু অংশটি হলদে । ডিম পাড়বার সময় হলেই এরা বাসা তৈরি করবার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজতে বের হয় । দুই-চার দিন ঘুরে-ফিরে মনোমতো কোনো স্থান দেখতে পেলেই তার আশেপাশে বারবার ঘুরে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখে । তারপর খানিক দূর উড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে এবং স্থানটাকে পুনঃপুনঃ দেখে নেয় । দু-তিনবার এরূপভাবে এদিক-ওদিক উড়ে অবশেষে কাদামাটির সন্ধানে বের হয় । যতটা সম্ভব নিকটবর্তী স্থানে কাদামাটি সন্ধান করতে সময় সময় দু-একদিন চলে যায় । কাদামাটির সন্ধান পেলেই বাসা নির্মাণের জন্য সেই স্থান থেকে নির্বাচিত স্থানে যাতায়াত করে রাস্তা চিনে নেয় । সাধারণত আশেপাশে চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ ব্যবধান থেকে মাটি সংগ্রহ করে থাকে । কিন্ত অত কাছাকাছি বাসা নির্মাণের উপযোগী মাটি না পেলে সময় সময় দেড়-দুশো গজ দূর থেকেও মাটি সংগ্রহ করে থাকে । কাছাকাছি কোনো স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করে বাসার একটা কুঠুরি নির্মাণ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় সেই স্থানে কাদামাটি চাপা দিয়ে বা বাসাটা সরিয়ে ফেলে দেখেছি – সংস্কারবশেই হোক আর বুদ্ধি করেই হোক, কুমোরে-পোকাটা বাসার সন্ধান না পেয়ে কোনো একটা জলাশয়ের পাড়ে উড়ে গিয়ে সেখান থেকে ভিজা মাটি সংগ্রহ করে পূর্বের জায়গায় নতুন করে বাসা তৈরি শুরু করেছে । যতবারই এরূপ করেছি, ততবারই দেখেছি – পুকুর বা নালা, ডোবা যত দূরেই থাকুক না কেন, সেখান থেকেই ভিজা মাটি এনে বাসা তৈরি করেছে । এইসব অসুবিধার জন্য অবশ্য বাসা নির্মাণে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে । একটি কুঠুরি তৈরি হয়ে গেলেই তার মধ্যে উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য, অর্থাৎ পোকামাকড় ভরতি করে তাতে একটি মাত্র ডিম পেড়ে মুখ বন্ধ করে তারই গা ঘেঁষে নতুন কুঠুরি নির্মাণ শুরু করে । কাজেই এ থেকে মনে হয় যে, কুমোরে-পোকা ইচ্ছামতো ডিম পাড়বার সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ।
বাসা নির্মাণের জন্য মাটি সংগ্রহ করবার সময় উড়ে গিয়ে ভিজা মাটির উপর বসে এবং লেজ নাচাতে নাচাতে এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে দেখে । উপযুক্ত মনে হলেই সেখান থেকে ভিজা মাটি তুলে নিয়ে চোয়ালের সাহয্যে খুব ছোট্ট এক ডেলা মাটি মটরদানার মতো গোল করে মুখে করে উড়ে যায় । মাটি খুঁড়ে তোলবার সময় অতি তীক্ষ স্বরে একটানা গুনগুন শব্দ করতে থাকে । মুখ দিয়ে চেপে চেপে মাটির ডেলাটিকে দেয়ালের গায়ে অর্ধ-চক্রাকারে বসিয়ে দেয় । মাটির ডেলাটিকে লম্বা করে চেপে বসাবার সময়ও তীক্ষ্ণস্বরে একটানা গুনগুন শব্দ করতে থাকে । কোনো অদৃশ্য স্থানে বাসা বাঁধবার সময়ও এই গুনগুন শব্দ শুনেই বুঝতে পারা যায়, কুমোরে-পোকা বাসা বাঁধছে । পুকুর ধারে কাদামাটির উপর মাছির মতো একপ্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা ঘুরে ঘুরে আহার সংগ্রহ করে । এরূপ স্থলে মাটি তোলবার সময় ওইরূপ কোনো পোকা তার কাছে এসে পড়লে মাটি তোলা বন্ধ রেখে তাকে ছুটে গিয়ে তাড়া করে । যাহোক, বারবার এরূপ এক-এক ডেলা মাটি এনে ভিতরের দিকে ফাঁকা রেখে ক্রমশ উপরের দিকে বাসা গেঁথে তুলতে থাকে । প্রায় সওয়া ইঞ্চি লম্বা হলেই গাঁথুনি ক্ষান্ত করে । এরূপ একটি কুঠুরি তৈরি করতে প্রায় দু-দিন সময় লেগে যায় । ইতিমধ্যে মাটি শুকিয়ে বাসা শক্ত হয়ে যায় । কুমোরে-পোকা তখন কুঠুরির ভিতরে প্রবেশ করে মুখ থেকে একপ্রকার লালা নিঃসৃত করে তার সাহায্যে কুঠুরির ভিতরের দেয়ালে প্রলেপ মাখিয়ে দেয় । প্রলেপ দেওয়া শেষ হলে শিকারের অন্বেষণে বের হয় । আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়সার অভাব নেই; তারা জাল বোনে না, ঘুরে ঘুরে শিকার ধরে । এই কুমোরে-পোকারা বেছে বেছে এরূপ ভ্রমণকারী মাকড়সা শিকার করে থাকে । কোনোরকমে মাকড়সা একবার চোখে পড়লেই হলো, ছুটে গিয়ে তার ঘাড় কামড়ে ধরে । কিন্তু কামড়ে ধরলেও একেবারে মেরে ফেলে না । শরীরে হুল ফুটিয়ে একরকম বিষ ঢেলে দেয় । একবার হুল ফুটিয়ে নিরস্ত হয় না । কোনো কোনো মাকড়সাকে পাঁচ-সাতবার পর্যন্ত হুল ফুটিয়ে থাকে । এর ফলে মাকড়সাটার মৃত্যু হয় না বটে, কিন্তু একেবারে অসাড়ভাবে পড়ে থাকে । তখন কুমোরে-পোকা অসাড় মাকড়সাকে মুখে করে নবনির্মিত কুঠুরির মধ্যে উপস্থিত হয় । কুঠুরির নিম্নদেশে মাকড়সাটাকে চিত করে রেখে তার উদরদেশের এক পাশে লম্বাটে ধরনের একটি ডিম পাড়ে । ডিম পেড়েই আবার নতুন শিকারের সন্ধানে বের হয় । সারাদিন অক্রান্ত পরিশ্রম করে দশ-পনেরোটা মাকড়সা সংগ্রহ করে সেই কুঠুরির মধ্যে জমা করে আবার দু-তিন ডেলা মাটি এনে কুঠুরির মুখ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় । তারপর দু-এক দিনের মধ্যেই পূর্বোক্ত কুঠুরির গায়েই আর একটি কুঠুরি নির্মাণ শুরু করে । সেই কুঠুরিটিও মাকড়সা পূর্ণ করে তাতে ডিম পেড়ে মুখ বন্ধ করবার পর তৃতীয় কুঠুরি নির্মাণ করতে আরম্ভ করে । এরূপে এক একটি বাসার মধ্যে চার-পাঁচটি কুঠুরি নির্মিত হয় । ডিম পাড়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলে সে তার ইচ্ছামতো যেকোনো স্থানে চলে যায়, বাসার আর কোনো খোঁজ-খবর নেয় না । বাচ্চাদের জন্যে খাদ্য সঞ্চিত রেখেই সে খালাস ।
Read Also:
ভরদুপুরে – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
সেনাপতি শংকর – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
পাইন দাঁড়িয়ে আকাশে নয়ন তুলি – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
মন ভালো করা – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
পশুপাখির ভাষা – গল্প | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
ঘাসফড়িং – কবিতা | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
কুমোরে পোকার বাসাবাড়ি গল্পের লেখক পরিচিতি:
গোপালচন্দর ভট্টাচার্য (১৮৯৫-১৯৮২): প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুত্রে তাঁর রচনার মূল উপাদান প্রকৃতি ও প্রাণীজগৎ । জীবজগতের খুঁটিনাটি তথ্য সহজ ভাব ও সরল ভাষায় তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন । লেখক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুসন্ধিৎসা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলিকে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছে । বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো – বাংলার মাকড়সা, বাংলার কীটপতঙ্গ ইত্যাদি ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.