পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘হাট’ কবিতাটি দেওয়া হল ।
হাট – কবিতা
দূরে দূরে গ্রাম দশবারোখানি,
মাঝে একখানি হাট,
সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ
প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট ।
বেচা-কেনা সেরে বিকালবেলায়
যে যাহার সবে ঘরে ফিরে যায়;
বকের পাখায় আলোক লুকায়
ছাড়িয়া পুবের মাঠ;
দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে ওঠে দীপ-
আঁধারেতে থাকে হাট ।
নিশা নামে দূরে শ্রেণিহারা একা
ক্লান্ত কাকের পাখে;
নদীর বাতাস ছাড়ে প্রশ্বাস,
পার্শ্বে পাকুড় শাখে ।
হাটের দোচালা মুদিল নয়ান,
কারো তরে তার নাই আহ্বান;
বাজে বায়ু আসি’ বিদ্রুপ-বাঁশি
জীর্ণ বাঁশের ফাঁকে;
নির্জন হাটে রাত্রি নামিল
একক কাকের ডাকে ।
দিবসেতে সেথা কত কোলাহল
চেনা-অচেনার ভিড়ে;
কত না ছিন্ন চরণচিহ্ন
ছড়ানো সে ঠাঁই ঘিরে ।
মাল চেনাচিনি, দর জানাজানি,
কানাকড়ি নিয়ে কত টানাটানি;
হানাহানি করে কেউ নিল ভ’রে,
কেউ গেল খালি ফিরে ।
দিবসে থাকে না কথার অন্ত
চেনা-অচেনার ভিড়ে ।
কত কে আসিল, কত বা আসিছে,
কত না আসিবে হেথা;
ওপারের লোক নামালে পসরা
ছুটে এপারের ক্রেতা ।
শিশির-বিমল প্রভাতের ফল,
শত হাতে সহি পরখের ছল –
বিকালবেলায় বিকায় হেলায়
সহিয়া নীরব ব্যথা।
হিসাব নাহি রে – এল আর গেল
কত ক্রেতা বিক্রেতা ।
নূতন করিয়া বসা আর ভাঙা
পুরোনো হাটের মেলা;
দিবসরাত্রি নূতন যাত্রী
নিত্য নাটের খেলা ।
খোলা আছে হাট মুক্ত বাতাসে,
বাধা নাই ওগো-যে যায় যে আসে,
কেহ কাঁদে, কেহ গাঁটে কড়ি বাঁধে
ঘরে ফিরিবার বেলা
উদার আকাশে মুক্ত বাতাসে
চিরকাল একই খেলা ।।
হাট কবিতার কবি পরিচিতি :
যতীন্দ্রনাথ সেগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪) : জন্মস্থান শান্তিপুরের হরিপুর গ্রাম । পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার । রবীন্দ্র সমসময়ে যে সমস্ত কবি স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পেরেছিলেন কবি যতীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম । কল্লোল গোষ্ঠীর জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে তিনি একজন । তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মরীচিকা, মরুশিখা, মরুমায়া, ত্রিযামা, সায়ম্, নিশান্তিকা প্রভৃতি । বাংলা কাব্যজগতে তিনি দুঃখবাদী কবি অভিধা পেয়েছিলেন ।
হাট কবিতার সারসংক্ষেপ :
কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘হাট’ কবিতাটি গ্রামের একটি হাটকে ঘিরে লেখা । দিনের বেলা হাটে অনেক কোলাহল থাকে । গ্রামের মানুষ হাটে জিনিসপত্র কেনাবেচা করে । কেউ লাভ পায়, কেউ খালি হাতে ফিরে যায় । হাটে চেনা-অচেনা মানুষের ভিড় লেগে থাকে । কিন্তু সন্ধ্যার পর হাট ফাঁকা হয়ে যায় । কেউ থাকে না, শুধু নির্জনতা । রাতের অন্ধকারে হাটে নিস্তব্ধ পরিবেশ নেমে আসে ।
হাটে দিনের বেলায় মানুষ আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবন ও কর্মের চিত্র ফুটে ওঠে । পুরোনো হাট ভেঙে আবার নতুন হাট বসে, মানুষ আসে যায় । এই হাট যেন আমাদের জীবনের চলমানতার প্রতীক । খোলা আকাশ আর মুক্ত বাতাসের নিচে হাটে জীবনধারার এক চিরন্তন খেলা চলে ।
হাট কবিতার নামকরণের সার্থকতা :
কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার নাম ‘হাট’ খুবই সার্থক । এই কবিতায় গ্রামবাংলার একটি হাটের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে । দিনের বেলা হাটে মানুষের কোলাহল, কেনাবেচা, আনন্দ ও দুঃখের গল্প আছে । আবার রাতের বেলা হাট ফাঁকা ও নির্জন হয়ে যায় ।
হাট এখানে শুধু একটি কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি মানুষের জীবনযাত্রার প্রতীক । জীবনের মতোই হাটে মানুষ আসে, জিনিস কেনে-বেচে, তারপর ফিরে যায় । তাই এই কবিতার নাম ‘হাট’ কবিতার বিষয়বস্তুকে পুরোপুরি তুলে ধরে এবং খুবই উপযুক্ত ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.