পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক রাজকিশোর পট্টনায়কের ‘ফাঁকি’ গল্পটি দেওয়া হল ।
ফাঁকি – গল্প
আটশো টাকা গুন্ঠ দরে জমি কিনে বাড়ি করার সময়ে বাপে আর ছেলেতে সর্বদা এক কথা – কোথায় বাড়ি হবে । ছেলে বলে, রাস্তার ধারে করা যাক, তাহলে রাস্তা থেকে নামলেই সহজে বাড়িতে ঢোকা যাবে । বাপ বলেন – এমন মরুভূমির মধ্যে কেউ বাড়ি করে না । চারিদিকে পাথরের মতো শক্ত শুকনো মাটি, এর মধ্যে বাড়ি করার মানে কী ?
– তাহলে কী করা যায়, বাবা ?
– এটুকু জমি খালি রাখা যাক, গাছপালা কিছু –
– হ্যাঁ বাবা, বাগান করব ।
– আগে গাছ লাগাব । তার পরে যত বাগান করবে করো ।
– কী গাছ ?
– আম গাছ পুঁতব এইখানে । কলমি গাছ । আমি একটা কলমি গাছ করেছি – বিরিবাটির বাগানে ।
ভালো আম । সেই যে ভাগলপুর থেকে ল্যাংড়া আম আনিয়েছিলাম – মনে নেই তোর ?
গোপাল মুখ তুলে সন্দিগ্ধভাবে বাবার দিকে তাকাল । বাবা কী কলম করেছিলেন কে জানে ! গাছ কি ভালো হবে ? ফুলের বাগান করলে কী সুন্দর হতো ।
– বাবা, ফুলের বাগান করলে ভালো হতো না ?
– এখানকার মাটি বেলে মাটি । জল দেবারও সুবিধা নেই ।
– বাবা, আমি জল দেব ।
– হ্যাঁ রে হ্যাঁ, তুই তো নিজের হাতে জল তুলে চানটুকুও করতে পারিস না ! তুই করবি বাগান !
– না বাবা !
– বেশ করবি তো কর । একটা আমগাছ এখানে থাকবে । তুই যত ফুলগাছ লাগাবি লাগা ।
আমের চারা আসলো – ছোটো একটি হাঁড়ির মধ্যে । কালো মাটির উপরে একহাত উঁচু আমগাছ । সবশুদ্ধ গণ্ডা আষ্টেক পাতা হলেও হতে পারে ।
– বল তো রে, কোথায় পোঁতা হবে ।
– বাবা, মাঝখানে পোঁতা । নইলে এর ডালপালা পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে চলে যাবে, রাস্তার ছেলেরা উৎপাত করবে । গাছের জন্য কোঁদল লাগবে, বাইরের কোঁদল এসে ঘরে ঢুকবে ।
– তোর কেবল ওইসব কথা ।
বাপের কথায় রাগ করে গোপাল চলে গেল বাড়ির ভিতর – মায়ের কাছে নালিশ করতে ।
– দেখো তো মা, বাবা আমগাছ নিয়ে পাঁচিলের কাছে লাগাচ্ছেন । গাছে আম ফললে পাড়ার ছেলেরা কি আর রাখবে ?
– ওগো ! আমগাছ ওখানে কেন লাগাচ্ছ ? গোপাল এদিকে রাগ করছে ।
– ওঃ ! তোমার ছেলে কিছু করবে না, খালি – এই আমগাছ হবে, তার ডাল পাঁচিল টপকাবে, রাস্তার ছেলেরা ঝগড়া বাঁধাবে – এইসব ! খুব হয়েছে, মা আর ছেলের একইরকম বুদ্ধি ।
– হ্যাঁ, একইরকম বুদ্ধি । ওখানে গাছ লাগানো হবে না ।
– আমি বলছি হবে । আমার জমিতে আমি গাছ লাগাব ।
– অ্যাঁ, তোমার জমি ? জমি আমার । তোমার নামে আছে, না ?
– যা পালা বলছি ।
মায়ে-পোয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেল, বিশেষ আলোচনার জন্য । – বাবা সব খারাপ করে দিচ্ছেন । বেশ, করুন ।
ঝগড়ার ফলে গাছ সরলো – দুই হাত ভেতরের দিকে । জল দেওয়া হলো । জন্তু জানোয়ার ঠেকাবার জন্য কঞ্চি দিয়ে বেড়াবন্দি করা হলো ।
সকালে গোপাল আর গোপালের মা উঠে প্রথমেই গেল আমগাছ দেখতে, গাছ নেতিয়ে পড়ে নেই তো ? না, বেশ তাজা আছে ।
মাকে গোপাল চুপি চুপি বলল – গাছটাকে আর দু-হাত ভেতরে লাগালে কত ভালো হতো ।
– আচ্ছা, এখানেই থাক । বাবা ভারি একগুঁয়ে, কী আর করা যাবে ?
– মা, আমি কিন্তু এ গাছের কিছু করতে পারব না ।
কারো হেপাজতের দরকার হয়নি । আপন চেষ্টাতেই গাছটি বেড়েছে । মা আর ছেলেতে কথা হয় – কলম ঠিক মতো করা হয়নি । সে কথা বাবাকে বলতে গিয়ে দুজনে বকুনি খায় ।
সে বাড়ির নিশানা হয়েছে আমগাছটি । কেউ গোপালবাবুকে তার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বোঝান – কাঠজোড়ি নদীর ধার বরাবর পুরীঘাট পুলিশের ফাঁড়ির পশ্চিমে যেখানে পাঁচিলের মধ্যে আমগাছ দেখবেন সেইখানে আমাদের বাড়ি ।
অনেক বন্ধুর কাছে এই দুষ্ট আমগাছটা ছন্নছাড়া স্বভাবের মানুষ গোপালবাবুর সহজ পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় । গাছ আপনাআপনি বাড়ছে, আলো বাতাস আর মাটি থেকে সে তার আহার যোগাড় করে বাড়ির পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে ।
নদীর ধারে গ্রীষ্মের গরম বাতাস সে তার সবুজ বুক দিয়ে ঠেকায় । কাঠজোড়ি নদীর দিক থেকে ছুটে আসা গরম বালির ঝাপটা আপন দেহ দিয়ে আটকায় । সর্বদা সকলের কাছ থেকে নানা অত্যাচার সহ্য করে সে চুপচাপ আপন মনে দাঁড়িয়ে থাকে ।
গোপাল তার বন্ধুদের এনে সেই আমগাছের তলায় বসায় । সবাই তারিফ করে, বলে এমনি জায়গায় এমনি আমগাছতলায় বসে যত ইচ্ছা বই লেখা যায় । গোপাল খুশি হয়ে বলে – এটা আমাদের পোষা গাছ, তাই এত সুন্দর হয়েছে । গাছ লাগানোর ইতিহাস গোপালের আর মনে ছিল না ।
শহর জায়গা । অনেক দূর থেকে লোকের এই আমগাছটির কথা মনে পড়ে । পূজা, বিবাহবাড়ি – সব কাজে গোপালবাবুর কাছে অনুরোধ আসে আমপাতার জন্য, আমের ডালের জন্য ।
কেউ চাইতে আসলে গোপালবাবু নিজে এসে গাছের কাছে দাঁড়ান – কচি পাতা নিও না, ওই থাক, এত পাতা গেলে গাছে কি আর ফল ধরবে ? কত লোক আসবে, ওই থাক ।
এমনি অশেষ সাবধানতার সঙ্গে গোপাল সেই ডাল-পাতা বিলোয় । পোষা আমগাছের পাতাগুলি সব বুঝি গোনাগুনতি হয়ে আছে । বাড়ির সবাইকার এক চিন্তা – গাছে কবে ফল ধরবে ?
– এই, দেখেছ ? আমগাছে বোল ধরেছে ।
– বাঃ, ভালো বোল হয়েছে, সব ডালে । আহা, বোল মোটে যদি না ঝরে পড়ে, কত আম হবে ।
– কেমন আম হয় দেখা যাবে ।
– জাত আম ।
– কে জানে, বাবা তো নিজেই কলম করেছেন । ভালো কলমি গাছ ফার্ম থেকে আনলে হতো না ? তা না, নিজেই কলম করেছেন ।
– আমরা ও আম খাব না ।
– বাবা, আমরা তোমার আমগাছের আম মোটে খাব না । মা বলছে ভালো আম নয় ।
– বেশ খেও না । গাছ তো কেঁদে ভাসাবে কিনা তোমরা না খেলে ।
কিন্তু সকালে সকলের মুখে উদ্বেগ । কুয়াশা হয়েছে । আমের বোল ঝরে যাবে – এই দেখো, বাতাসে মটরদানার মতো বোল ঝরে ঝরে পড়ছে । আগুন লাগানে পিঁপড়েগুলো সব খেয়ে ফেললে ।
– আচ্ছা করে ডিডিটি দেব, পিঁপড়ে মরে যাবে ।
– আরে, আম হয়েছে – !
বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে গুনতে আরম্ভ করে । অনেকবার গোনা হয় । পাতার আড়ালে আবার কোথায় একটা বাকি রয়ে যায়, হিসেবে ভুল হয় । – দেখো ছেলেরা, গুনে রাখ । দেখা যাবে কটা আম হয় এতখানি বোল থেকে ।
পাড়ার ছেলেদের চোখে পড়ে যায় । ঢিপ ঢাপ ঢিল ছোড়া শুরু হয় ।
– এই, নজর রেখো এই ছেলেগুলোর উপরে ।
আম হলে কেউ তো খাবেই । দুপুরে নজর রাখা এক কাজ হলো । প্রত্যেকটি আম এক একটি অমূল্য সম্পদ । পাকলেও আমের উপরটা সবুজ রয়েছে । ভেতরকার রং হলদে না হলেও গেরিমাটির রং দেখাচ্ছে । টক না হলেও মিষ্টি নয় । সবাই এক এক ফালি খেয়ে তারিফ করে – বাড়ির হাঁদা ছেলেকে সবাই যেমন আদর করে গায়ে হাত বুলায় ।
– আমাদের আম খুন্টুনি দিয়ে পাড়ব । দেখেশুনে পাড়লে নীচে পড়ে থেঁতলে যাবে না ।
বাড়ির সবাই মিলে খুব সাবধানে আম পাড়ে ।
– আরে দেখেছ ! ভালো করে দেখো, কাঠবিড়ালি আর বাদুড়ের চোখ এড়ায় না কোনো আম । আমরা এতজনে মিলে আম পাড়লাম, তবু রোজ কাক বাদুড় কাঠবিড়ালির এঁটো করা আম পড়ছে কোত্থেকে কে জানে ! পিঁপড়েও মরেনি, আধখাওয়া আমে ঠিক লেগে আছে ।
এত যত্ন করে যে কয়টা আম ঘরে তোলা হয় তার গোনা-গুনতি দুই চারটি করে বিলানো হয় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের । বাড়ির সকলের সঙ্গে একেবারে মিলে মিশে গিয়ে আমগাছটি পরিবারের একজনের মতো হয়ে উঠেছে । কেবল তার নাম দেওয়া হয়নি এই যা ।
এই যুদ্ধের সময় আমগাছের উপর দিয়ে এক বিপদ যাচ্ছে । উড়োজাহাজ থেকে যদি বোমা পড়ে তবে তার হাত থেকে বাঁচবার জন্য সরকারের লোক ট্রেঞ্চ খুঁড়ে রেখে গেছে একেবারে আমগাছের গোড়া পর্যন্ত । সেইদিন থেকে গাছ হেলে পড়েছে পূর্ব দিকে । যতই ঠেকো দেওয়া যাক, সিধে হচ্ছে না । কী করা যায় ? শিশুকালে টাইফয়েড হলে ছেলে যেমন চিরদিন রুগ্ন থেকে যায়, তেমনি – বোমা তো পড়ল না – ট্রেঞ্চ খুঁড়ে আমগাছটিকে কমজোর করে দিয়ে গেল । খোঁড়া মানুষের হাতে যেমন লাঠি দেওয়া হয়, হেলে পড়া আমগাছকে একটা পেয়ারা গাছের দো-ফেঁকড়া শক্ত ডাল দিয়ে তেমনি ঠেকো দেওয়া হয়েছে । পিঁপড়ে কাঠবিড়ালি সেইদিক দিয়ে আর একটি পথ খুলে গাছের উপর যাওয়া আসা করছে । লোক এলে গেলে তার গায়ে সাইকেল ঠেসান দেয় ।
ফি বছরই সেই এককথা – এ বছর কত আম ফলবে ? তিন বছরে একবার ফলন ভালো হয় । গেল বছর হয়েছিল একশো থেকে পাঁচটি কম । এবার দেখা যাক ।
কারো হঠাৎ দয়া হলে দুই এক তাল গোবর নয়তো এক ঘটি জল ঢেলে দেয় গাছতলায় । সকলের নজর গাছের পাতার দিকে । এ বছর কাউকে পাতা দেওয়া হবে না, গাছ কাহিল হয়ে যাবে, ফলবে না ।
– মা, গাছটা রাস্তার উপরে বড্ডো ঝুঁকে পড়েছে, যেতে আসতে মাথায় লাগে, বৃষ্টির সময়ে পাতার জলে গা ভিজে যায় । কেটে দেব কয়টা ডাল ?
– দ্যাখ গোপাল, আমগাছে হাত দিলে ঝগড়া হবে তোতে আমাতে । এমনি শাসানি সত্ত্বেও গোপাল চুপি চুপি কয়েকটা সরু সরু ডাল কেটে ফেলে, কেটে একেবারে বাইরে ফেলে দিয়ে আসে । মা জানবার কী দরকার, রাস্তাটা সাফ হলেই হলো ।
তবু গাছটার কত মায়া । তার পাতার আড়ালে সব ক্ষতচিহ্ন সে লুকিয়ে ফেলে । গোপালের মায়ের চোখ তা ঠাহর করতে পারে না । গোপাল গিয়ে হাত বুলিয়ে দেয় গাছের গায়ে । ঠিক বন্ধুর মতোই গাছ সব কথা লুকিয়ে রেখেছে ।
সে বাড়ির একটা অঙ্গ সেই গাছটি, বাইরের লোককে পথ দেখাবার জন্য বাইরের বিজলি আলো জ্বালিয়ে গাছ তা আড়াল করে দেয় । ভেতরের কথা লুকিয়ে রাখে বাইরের লোকের কাছে । বাইরের লোককে আপন আড়ালের ওপাশে রাখে ।
কত ঝড় বৃষ্টি গিয়েছে, প্রতি বছর যত ফুল ফল কুঁড়ি ও পাতা সে ফেলেছে আবার ততই এসে ভরেছে । গোপাল বড়ো হয়ে বুড়ো হতে চলল, গোপালের বাবা মা ভাইবোন ভাগনে ভাইপো সকলেই এগোচ্ছে, গাছটির বয়স বাড়ে না । হয়েছে কাছের দালানটার সমান উঁচু । যতখানি জায়গা নিয়েছিল তেমনি রয়েছে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখে মানুষের ছেলেরা ছোটো থেকে বড়ো হচ্ছে বুড়ো হচ্ছে ।
প্রতি বছর কাক এসে বাসা বাঁধে । বর্ষাকালে বেনেবৌ এসে বসে । রাতে কাল পেঁচা এসে ডাকে, রোজ কাঠবিড়ালি খেলা করে । ফি বছর ছেলেপিলেরা তাতে দোলনা টাঙায় । তাদের কলরব কল্লোল, তাদের উৎসাহ আনন্দ সেই আমগাছটির গায়ে গোড়ায় লুটিয়ে পড়ে ।
প্রত্যেক বছর ঝড় বয়েছে । আমগাছ তাতে কেঁপেছে । তার ডালে-পাতায় পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । গাছের নীচে পিঁপড়ে শিকার করতে পিঁপড়ে-বাঘ বেলে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসে থেকেছে । বাতাস তেমনি গাছ জড়িয়ে, ডাল দুলিয়ে বয়ে গেছে । সে গাছ অজর ।
গাছ জানে না, বোঝে না । তাকে উপলক্ষ করে যে যা করে, যে যা ভাবে তার সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ নির্বিকার । দোলনা পাছে পড়ে যায় বলে তার গায়ে ভোমর করে মোটা প্যাঁচ আঁটা হয়েছে । মানুষ আর গাছ জীবনের বিভিন্ন প্রকাশ, কিন্তু দুইই পোষ মানে । পোষা মানুষ কাজের বেলায় কৃতঘ্ন হয়, পোষা গাছ সর্বদা কৃতজ্ঞ আর বাধ্য ।
ঝড় আসে, আসবে । তাতে ভাবার কিছু নেই ।
সকালবেলা বাড়িতে হইচই । – আরে ! দেখেছ, কাল রাতে আম গাছ ভেঙে পড়ে গেছে ! – ভাই, ওঠ !
– আরে গোপাল, ওঠ ! আমগাছের দশা দেখেছিস ?
সবাই ছুটে গেল আমগাছের কাছে । গোপাল দেখল আমগাছ পড়ে আছে মাটির উপরে তার দোলনা বাঁধা দড়ি তার ডালের নীচে চাপা পড়েছে । দাঁড়িয়ে থাকাতে যত উঁচু ছিল, পড়ে গিয়েও তার ডালপালা তত উঁচু হয়েই রয়েছে ।
গোপাল ঘুরে ঘুরে দেখল গাছের একটা দিক উইয়ে অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, ফোঁপরা হয়ে গেছে । আর অর্ধেক ভেঙে গেছে ।
– কিরে গোপাল, ওষুধ দিয়ে পিঁপড়ে মারছিলি না ? পিঁপড়ে থাকলে উই লাগত না । এত বড়ো গাছটাকে উইয়ে খেয়ে ফেললে । গেল – !
– পিঁপড়ে তো মোটে রইল না, উইয়ের রাজত্ব হলো । কাঁচা গাছটাকে ভোজ করে দিলে !
কাঠবিড়ালিগুলো দূরে ঘোরাফেরা করছিল ।
– আর কী খাবি রে, কাঠবিড়ালি ? আমগাছ মরে গেছে ।
নদীতে স্নান করতে আসে-যায় যারা, পথে চলা পথিকেরা দাঁড়িয়ে যায়, বলে – কী ঝড়টা না হয়েছিল, এত বড়ো ফলন্ত গাছটা উপড়ে পড়ল ! আহা ! আহা !
গাছটা কত ভালো । পড়েছে যে, তা ঘরের উপর পড়েনি । বাড়ির উপরকার বিজলি বাতিটা ভাঙেনি । দিনের বেলা পড়েনি । ডালে কাকের বাসা তেমনি আছে । কালো কালো ছানাগুলো উড়তে শেখেনি, চ্যাঁ চ্যাঁ করছে ।
সে গাছ আর নেই । ভারি বুদ্ধিমান গাছ ছিল । সেই হৃদয়বান আমগাছটি আর বেঁচে নেই । কাঠুরিয়া এসে কুড়াল দিয়ে গাছের পাবে পাবে টুকরো করে কেটে দিয়ে গেল । পাখির বাসাওলা ডালটি আর একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলো ।
খবর কাগজে লিখেছিল – কটকে অর্ধরাত্রে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি । শহরের ভিতরে পুরীঘাটে আমগাছ উপড়ে পড়েছে । গাছটির মৃত্যু-সংবাদ খবর কাগজে বের হলো । কী কপাল জোর তার !
দুই দিন পরে সন্ধ্যাকালে গোপালবাবু কাকে নিজের বাড়ির নিশানা দেবার সময় বলছিলেন – পুরীঘাট পুলিশের ফাঁড়ির পশ্চিম দিকে গেলে যেখানে প্রথম আমগাছ পাবেন – না না, ভুল বললাম, সে আমগাছটি পড়ে গেছে এই ঝড়ে ।
আষাঢ়ের ঝড় আপন পরাক্রম দেখাতে লুটে নিল একটি নিরীহ নিরপরাধ আমগাছকে, তায় আবার সে ছিল দুর্বল, উইয়ে খেয়েছিল । কিন্তু সে বাড়ির সেই মানুষদের একটি বন্ধু ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ।
– সেই ঝড়ের রাতে ।
Read Also:
ফাঁকি – প্রশ্ন ও উত্তর | ষষ্ঠ শ্রেণি | সাহিত্যমেলা
ফাঁকি গল্পের লেখক পরিচিতি :
রাজকিশোর পট্টনায়ক (জন্ম ১৯১৬) : ওড়িয়া সাহিত্যের একজন বলিষ্ঠ লেখক ও গল্পকার । ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয় । পেশাতে আইনজীবী । একজন নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যসাধক । আধুনিক জীবনের নর-নারীর মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচনায় । তাঁর লেখা বিশিষ্ট গল্পগ্রন্থগুলি হলো পথুকি, তুঠ পাথর, ভড়াঘর, নিশান খুন্ট, পথর ঢিমা । আর উপন্যাসগুলির মধ্যে অসরন্তি, সিন্দুর গার, স্মৃতির মশাণি, চলাবাট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । পাঠ্য ফাঁকি গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রমোহন জোয়ারদার ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.