পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBBSE) অনুমোদিত ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই “সাহিত্যমেলা” । এখানে লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘আশীর্বাদ’ গল্পটি দেওয়া হল ।
আশীর্বাদ – গল্প
বর্ষা খুব নেমেছে । নীচেও ডেকেছে বান । জলে দেশ থইথই করছে ।
একটি পিঁপড়ে আশ্রয় নিয়েছে একটি ঘাসের পাতার নীচে ।
পাতাটা কাঁপছে । হেলে পড়ছে । বৃষ্টির ফোঁটার ঘায়ে পাতাটা বোধহয় এলিয়ে পড়বে জলে । আর একটুকুতেই, পিঁপড়েটা, অসীম জলে ভেসে যাবে-যাবে হয়েছে ।
পাতা বললে – ‘ভাই, জোরে আঁকড়ে ধরো । কামড়ে ধরো আমাকে; আমার লাগবে না । ভয় পেয়ো না, তোমরা তো সাঁতার জানো, হেঁটে, দৌড়েও চলো, তোমাদের আবার কী ?
পাতার শিরা কামড়ে ধ’রে পিঁপড়ে আধ-গলায় বললে – ‘দেখো, শরীরটা জলে ডুবে গেল, দাঁড়াও ভাই, বলছি ।’
এক ঢোঁক জল খেয়ে পিঁপড়ে আর কিছু বলতে পারলে না । চোখ বুজে পাতাতে দাঁত বসিয়ে, ডুবু-ডুবু হয়ে ঝুলে রইল ।
পাতা হাসলে – ‘ভাই, ভাগ্যে তুমি জিমনাস্টিকস জানতে । আমরা নড়তেও পারিনে । কোনোরকমে শুঁড়-টুড় বাড়াই । চলতেই জানলেম না, তা, ঝুলব কোথায় গিয়ে ?’
বৃষ্টি একটু ধরল । ঘাসের পাতাটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে । কামড় আর নিশ্বাস ছেড়ে, পিঁপড়ে বললে – ‘বাপ ! বাঁচলেম ! বলছিলে ভাই, ঠিক । আমরা সাঁতার জানি; হাঁটতে জানি, দৌড়োতেও খুব । দুত্তোর । কাজে আসে না কোনোটাই । ডাঙায় রোদ্দুরের দিনে পুড়ে মরি, বর্ষায় তুমি ছিলে তাই আজ
বেঁচে গেলাম -‘
– ‘ও কথা বলে লজ্জা দিও না ।’ হাতে হাত দিয়ে ধরে বললে পাতা । ‘বাঁচন আর মরণ নাকি একটা কথা ? তুমি যে কাজের লোক ভাই ! ওইটেই আসল ।’
শুনে, বর্ষাতেও পিঁপড়ের মুখ শুকিয়ে গেল ! ভিজে শরীরে শুকনো মুখে সে বললে – ‘ভাই, কাজ তো করিই । সারা দিন-রাত খাটি । খাটি । খাটি । শুধু খাই । দাই । থাকি গর্তে । তোমরা পৃথিবীর উপরে হাসো, ফুলটুল ফুটাও । আমরা যাই, আসি, দেখি । ছাই ও-কাজ । শেষে আবার সেই গর্তেই ঢুকি গিয়ে । বুঝি ভাই, মাটি আমাদের, পৃথিবীটা তোমাদের ।’
শিউরে পাতা বললে – ‘ভাই, অমন কথা বোলো না; মাটি সবারই । থইথই যে জল, মাটি না থাকলে চলত কোথা দিয়ে ?’
পিঁপড়েও শিউরোল – ‘হায় ! এ জল কী করে পার হব ?’
বৃষ্টি ঝম-ঝম করে এল । তাড়াতাড়ি পিঁপড়ে আবার কামড়ে ধরলে পাতা ।
বৃষ্টি দাঁড়াল । ‘ভাই, শুনেছিলাম তোমাদের কথা । মেঘের আড়াল থেকেও শুনেছি । পিঁপড়ে ভাই, বড্ড তোমার ভয় ? না ? কিন্তু ওই পাতা বন্ধুটিকে আমি কোনোদিন ভয় পেতে দেখিনি । আমরা চলে যাই বিদেশে, ফিরে এসে দেখি, রোদ্দুরে পুড়ে বন্ধুর দল ধুলো হয়ে আছে । যেই দি ডাক, আর, ধুলো ঝেড়ে সারা দেশে সবুজ হয়ে ওঠে সবুজ পাতা চিরদিন । আমি আনন্দে গান গেয়ে উঠি সবুজ বন্ধুর হাত ধরে ।’
খল খল করে হেসে উঠল জল, ঢেউ তুলে – ‘তুমি গান গাচ্ছ, আমিও গাই । বর্ষায় যে ঘাসকে আমি ডুবিয়ে, কাদায় লুটিয়ে, তলিয়ে দিয়ে ছুটি, শরতে চেয়ে দেখি, তারাই কাশবন হয়ে হাসছে !’
ঘাসের পাতা আস্তে মাথা নোয়ালে হাওয়ায় ।
পিঁপড়ে জড়িয়ে ধরল পাতার শিরা । বুক ভেঙে নিশ্বাস পড়ল পিঁপড়ের । হায় ! পিঁপড়ে আমি চিরদিন পিঁপড়ে হয়েই রইলেম ! তবু ছিলেম গর্তে, ছিলেম ডাঙায় । এ জল কি শুকুবে কোনো দিন ?
ঘাসের পাতা মাথা নুইয়েই ছিল । এবারে মাথা একটু তুলল । তারপর বললে পিঁপড়ের কানে কানে – ‘বন্ধু, ভাই, ভয় তুমি পেয়ো না । ভেবো না একটুও । বাদল চলে যাবে, চলে যাবে এ জল নিশ্চয় । আসবে । আসবেই।| আসছে শরৎ ।’
পৃথিবী তোমার হবে ।
পিঁপড়ে চোখ তুললে । আহা, পৃথিবী কি আবার তার হবে ! পিঁপড়ের চোখে জল, আসতে আসতে, থামল ।
চেয়ে সে দেখলে, মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের চোখও হাসছে ।
হবেই । আশীর্বাদ করি, শরতের আশীর্বাদ তোমাদেরও উপরে ঝরুক ।
পৃথিবী সবারই হোক।
আশীর্বাদ গল্পের লেখক পরিচিতি :
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৬) : বাংলাদেশের ঢাকা জেলার উলাইল গ্রামে বিখ্যাত মিত্র মজুমদার বংশে দক্ষিণারঞ্জনের জন্ম । তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ উত্থান । কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবন শুরু করলেও তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত রূপকথা, উপকথা ও লোককথার গল্প । গ্রামে গ্রামে ঘুরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখের গল্পকথাকে সংগ্রহ করে নিজের মতো করে মূল কাহিনিটি লিখতেন । দক্ষিণারঞ্জন ১৯৩০-১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর সহসভাপতি ছিলেন । তাঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থগুলির নাম – ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, দাদামশায়ের থলে, উৎপল ও রবি, কিশোরদের মন, বাংলার সোনার ছেলে, চিরদিনের রূপকথা ইত্যাদি । ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় শিশু সাহিত্য পরিষদ তাঁকে ভুবনেশ্বরী পদক দিয়ে সম্মানিত করেন ।
Follow us:
If you like this article, you can Follow us on Facebook.
Also, you can Subscribe to our YouTube Channel.